আজকাল ওয়েবডেস্ক: স্মার্টফোন কি বর্তমান প্রজন্মকে ঘরকুনো করে দিয়েছে। চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা কী কমে যাচ্ছে? চাকরি বাজারে পা রাখতে গিয়ে কেন বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে পড়ুয়াদের। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের কলেজ মেঘনাদ সাহা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির কর্তৃপক্ষ দেখলেন, বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিন্তা করা, যুক্তির পাল্টা যুক্তি সাজানোর ক্ষমতা কমে গিয়েছে। এর অন্যতম কারণ, তাঁরা আজকাল আর বাইরে গিয়ে আড্ডা দেন না। মোবাইলেই বন্দি হয়ে যাচ্ছে জীবন। তাই প্রতিষ্ঠানের বিশেষ উদ্যোগে শুরু হয়েছে বিশেষ ‘আড্ডা সেশন’। সপ্তাহে একদিন ‘ভার্বাল গুরু’ সজল মিত্রের তত্ত্বাবধানে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই আড্ডার আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য, চাকরির বাজারের প্রবল প্রতিযোগিতায় পড়ুয়াদের সবরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি রাখা।

মেঘনাদ সাহা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসার ইনচার্জ তথা এই আড্ডা সেশনের কোঅর্ডিনেটর শৈবাল ব্যানার্জি বলেন, “আজকাল দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা অনেক নম্বর পাচ্ছে। সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকেই নম্বরের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছে। যে সকল ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন তাঁরা সকলেই প্রযুক্তিগত দিক থেকে পটু। কারণ সেই প্রযুক্তির বিষয়েই তাঁরা শিখতে আসছেন।“ তিনি আরও বলেন, “এই প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেকে কীভাবে তৈরি করবেন, সকলের থেকে নিজেকে কীভাবে আলাদা করবেন? সেই উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত করতে আমরা সফট স্কিল ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারপার্সোনাল স্কিল, গ্রুপ ডিসকাশন, মক ইন্টারভিউ ইত্যাদি। এই স্কিলগুলি তথাকথিত সিলেবাসে থাকে না। কিন্তু একটি ভাল জায়গায় পৌঁছতে এই স্কিলগুলি দরকার।“ 

শৈবাল জানিয়েছেন, এই প্রোগ্রাম চলাকালীন দেখা গিয়েছে অনেক পড়ুয়ার মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তাধারার অভাব রয়েছে। অন্য কোনও ভাবে তাঁরা ভাবতেই চাইছেন না। গতে বাঁধা পড়াশোনার বাইরে চিন্তার ক্ষমতাই নেই। এর ফলে কেউ চাকরি পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। কিন্তু কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, চার বছর বাদে কী করব সেই বিষয়ে কেউ ভাবছেন না। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়েছি বলে ভবিষ্যতেও তা নিয়েই কাজ করব তা তো নয়, অন্যান্য কাজও করতে পারি। 

তিনি বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেন চিন্তাভাবনার অভাব তা খতিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেল, ছোটবেলায় বড়দের আমরা আড্ডা মারতে দেখতাম। আমরা নিজেরাও আড্ডা মেরেছি। কিন্তু এখন সে সবের বালাই নেই। তাই বর্তমান প্রজন্ম চিন্তু-যুক্তি-তর্ক, এসবের থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে। এরপরেই আমরা ভেবে দেখলাম যে, ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে তো রাস্তায় বসিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে না। এমন কিছু করে আড্ডার আয়োজন করা হোক যার ফলে তাঁদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিংয়ের বিষয়টি জাগিয়ে তোলা যায়। তাঁদের মনে নিজে থেকে প্রশ্নও আসবে এবং উত্তরও আসবে।“

আরও পড়ুন: ইউপিএসসি-তে সুযোগ পেয়েও থামতে চান না রিশিতা, কাজে যোগ দিলেও চলবে আইএএস হওয়ার লড়াই

সেই উদ্দেশ্য সাধনে মেঘনাদ সাহা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ‘আড্ডা সেশন’ বলে একটি বিশেষ সফট স্কিল প্রোগ্রাম চালু করেছে। যেখানে ছাত্রছাত্রীদের একটি বর্তমান বিষয় সম্পর্কে এবং মাঝেমধ্যে পুরনো বিষয় সম্পর্কে তর্ক সভার আয়োজন করা হয়। এক দল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় কারা পক্ষে এবং কার বিপক্ষে বলবেন। এর ফলে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির একটি সেশন চলে। এরপর সবকিছুর বিশ্লষণ করা হয়। এর মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্তে আসা হয় যে, যাঁরা পক্ষে বলেছেন না যাঁরা বিপক্ষে বলেছেন, কারা ঠিক। এর ফলে দুই পক্ষই ভেবে দেখার সময় পাচ্ছে। প্রতিটি প্রশ্ন বা উত্তর বিশ্লষণ করার সময় পাচ্ছে। এর ফলে তাঁদের চিন্তাশক্তিও আরও ঊর্বর হচ্ছে। বাস্তবে চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময় এই চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা কাজে লাগে। কিছু প্রশ্ন এমন থাকে যেখানে হঠাৎ একটি পরিস্থিতি তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই সময় চাকরিপ্রার্থীরা কীভাবে সেই পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন, তাঁদের যুক্তি কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখে সংস্থাগুলি। সেখানে সফল হলেই চাকরি পাওয়া আরও সহজ হয়ে ওঠে। টেকনিক্যাল স্কিলের পাশাপাশি এই বিষয়েও দক্ষতা প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই বিষয়ে আরও সচেতনতা তৈরি করা।

তিনি জানিয়েছেন, ২০২৩ সাল থেকে চলা এই আড্ডা সেশনেই প্রকাশ পেয়েছে কোনও পড়ুয়া ক্যাট পরীক্ষা দিয়ে এমবিএ করতে চান। কেউ বা চাকরিবাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে চান।

তিনি আরও বলেন, "প্রথম বর্ষে যখন পড়ুয়ারা ভর্তি হতে আসেন তখন আমরা একটি মক ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করি। আমরা সেই সময় বোঝার চেষ্টা করি তাঁদের ঝোঁক কোনদিকে। সেই অনুযায়ী আমরা এ, বি, সি স্তরে ভাগ করি। আগামী তিন বছরে আমাদের লক্ষ্য থাকে বি স্তরের পড়ুয়াদের এ স্তরে এবং সি স্তরের পড়ুয়াদের বি স্তরে উন্নীত করা। এর উদ্দেশ্য কোর্স শেষে যাতে পড়ুয়ারা তৈরি হয়েই প্রতিযোগিতায় পা রাখতে পারেন। প্রোগ্রামটির নাম স্কিলিং অ্যান্ড গ্রুমিং দি রুটস।“

তিনি জানিয়েছেন, এই প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে পড়ুয়াদের স্কিল যে শুধু এ, বি, সি- তে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় তা নয়। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা বোঝার চেষ্টা করি কতজন উদ্যোগপতি হতে চান, কতজন উচ্চশিক্ষায়, কতজন চাকরি করতে চান ইত্যাদি। সেইমতো দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বর্ষে তাঁদের তৈরি করা হয়।