অতীত আর বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধে দিলে কোন দিকে মোড় নেয় জীবন? সেই গল্পই বলবে রোহন সেনের ‘কন্যা’। দিদির প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে সুখের ঘর সাজায় বোন। একদিকে যখন সংসার ভাঙে, অন্য দিকে জন্ম নেয় প্রেম। সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে তৈরি এই ছবিতে দুই কন্যার একজন প্রিয়াঙ্কা সরকার। কাজ থেকে জীবন, সাফল্য থেকে ব্যর্থতা—  নায়িকার মনের কথা শুনলেন আজকাল ডট ইনের সঞ্চারী কর।

কেমন আছেন?

(একগাল হেসে) ভাল আছি। সামনে আমার নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তাই আরেকটু বেশি ভাল আছি বলতে পারি।

অ্যাকশন আর গোয়েন্দা ছবির ভিড়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প। বহুস্তরীয় চরিত্র করার খিদে থেকেই কি ‘কন্যা’কে বেছে নেওয়া?

একদমই তাই। যে কোনও অভিনেতারই এরকম চরিত্র করার খিদে থাকে। আমরা তো মানুষ হিসাবে অনেক কিছুই অনুভব করি। কিন্তু তা বলে উঠতে পারি না। আমাদের জীবনের সম্পর্কগুলো ঘিরে যে অনুভূতি আর জটিলতা, সেগুলি চিত্রনাট্যে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পড়েই মনে হয়েছিল চরিত্রের এতগুলো স্তর ফুটিয়ে তুলতে পারব তো! দর্শককে বুঝিয়ে আদৌ উঠতে পারব? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই এই চরিত্রটা করে ফেললাম। আমাদের পরিচালক রোহন সেনও খুব সুন্দর করে আবেগের গভীরতাটা বুঝিয়েছে। চারপাশে যেমন মানুষ আমরা দেখি, ঠিক তেমন করেই পর্দায় নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আসলে আমরা কেউই তো নিখুঁত নই। সেটা মেনে নিলেই জীবন আর অভিনয়, দুটোই সহজ হয়ে যায়।

দিদির প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে যে বোন ঘর বাঁধে, তাকে সমাজ কিন্তু আজও আতশকাচের তলায় রাখে…

খুব সত্যি কথা। কিন্তু আমি ছবিতে আমার করা চরিত্রটাকে আতসকাচের তলায় রেখে কাটাছেঁড়া করতে পারিনি। কারণ চিত্রনাট্যই আমাকে বলে দিয়েছে কেন সুকন্যাকে (প্রিয়াঙ্কা অভিনীত চরিত্র) সব রকম জাজমেন্টের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। আর সেটার জন্য সকলের ছবিটা দেখার দরকার। এই রকম ঘটনা বা এর থেকেও জটিল ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটলেও অনেক সময় সামনে আসে না। ‘কন্যা’ দুই বোনের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই গল্পকেই তুলে ধরেছে। 

ঋষি কৌশিকের সঙ্গেও প্রথম জুটি বাঁধলেন…

হ্যাঁ, ঋষিদার সঙ্গে এটা আমার প্রথম কাজ। ওঁকে মানুষ এবং অভিনেতা হিসাবে শ্রদ্ধা করি। খুব ভাল লেগেছে অভিনয় করতে।

প্রথম বারেই এত সুন্দর রসায়ন তৈরি করলেন কীভাবে? 

পুরো কৃতিত্বটাই আমার পরিচালক রোহনের। আমি ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর। ও যে ভাবে যা করতে বলেছে, আমি করেছি। শুধু প্রেমের রসায়নই নয়, ছবিতে দুই বোন অর্থাৎ আমার আর অমৃতাদির মধ্যে যে সমীকরণটা ও গড়ে তুলেছে, সেটাও আমার কাছে খুব সত্যি মনে হয়েছে। অভিনয় করতে গিয়ে এখন অমৃতাদি (দে) বাস্তবেও আমার দিদি হয়ে গিয়েছে। আসলে আমরা আমাদের চারপাশের নিখাদ ঘরোয়া, পারিবারিক গল্প বলতে চেয়েছি। তাই বোধ হয় সবটা অজান্তেই এরকম মিলেমিশে গিয়েছে।

ইদানীং পারিবারিক গল্প নিয়ে তৈরি ছবিকে কিন্তু ‘একঘেয়ে’, ‘ঘ্যানঘ্যানে সিরিয়াল’ বলে কটাক্ষ করা হয়…

যে ছবিগুলোকে নিয়ে এসব বলা হয়, সেগুলির বক্স অফিস কালেকশনটা একবার দেখলে বোধ হয় আর এই কটাক্ষ করা হবে না। আরেকটা বিষয় বলি। প্রেক্ষাগৃহে আসা আমাদের অনেক ছবিই দর্শক দেখতে যান না। মুখ ফিরিয়ে নেন। কিন্তু ধারাবাহিকের একটি এপিসোডও কিন্তু তাঁরা মিস করেন না। পুনঃপ্রচারও দেখেন। কারণ সেখানে তাঁরা নিজেদের দেখতে পান। তাই বছরের পর বছর ধারাবাহিকের প্রতি তাঁদের আগ্রহ এতটুকু কমেনি। লার্জার দ্যান লাইফ ছবি যেমন দর্শকের ভাল লাগে, তেমন এরকম জীবনমুখি, পারিবারিক ছবিও কিন্তু তাঁরা লুফে নেন।

আপনিও তো কম নন! সাহসী পোশাকে আইটেম সংও করেন আবার পাশের বাড়ির মেয়েও হয়ে ওঠেন নিমেষে…

(হেসে উঠে) এটাই তো আমার কাজ। প্রত্যেকটা চরিত্রকে যদি আমি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারি, সেটাই আমার সাফল্য। ‘কন্যা’তেও আমার করা চরিত্রটাকে আপাতভাবে খুব সাধারণ মনে হলেও, এটাকে ঠিক করে ফুটিয়ে তোলা ছিল খুব কঠিন। পরিচালক-প্রযোজকরা যে ভরসা করে আমাকে এই ধরনের কাজ দেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

কঠিন চরিত্র করতে গিয়ে কি ব্যক্তিগত জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগালেন?

নিশ্চয়ই। আমার জীবনের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে কিছু না কিছু শিখিয়েছে, সেগুলো অবশ্যই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আবার দেখুন, বাস্তবে আমি নিজে একজন দিদি। আমার বোন আছে। ওকে যেমন খুব ভালবাসি, ওর সঙ্গে প্রচুর ঝগড়া-খুনসুটিও হয়। বকাবকিও করি। এই ছবিটা কিন্তু আমায় আমার বোনের দৃষ্টিকোণটা বুঝতে সাহায্য করল। অর্থাৎ জীবন থেকে যেমন ছবিতে অনেক কিছু দিই। তেমন ছবিও জীবনকে ততটাই ফিরিয়ে দেয়।

যে ছবির জন্য এমন মনপ্রাণ ঢেলে দেন, তার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও কি একই রকম মাথাব্যথা থাকে?

ভীষণ ভাবে থাকে। একটা সময় ছিল যখন এগুলো নিয়ে ভাবতাম না। মনে হত, আমি আমার কাজটা করে দিয়েছি। দায়িত্ব শেষ। কিন্তু জীবন, কেরিয়ার আমাকে অন্য ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এখন শুধু অভিনয় করাই নয়, ছবির প্রচার, বক্স অফিসের হিসেবনিকেশ, সব কিছু নিয়েই চিন্তা থাকে। আমার মনে হয়, একটা ছবির সঙ্গে জড়িত সকলকে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। দর্শকের কাছে একটা ছবিকে কী ভাবে পৌঁছে দেওয়া, কী ভাবে তাঁদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করা যায়, সেগুলো নিয়ে ভাবাও আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। রোহন তুলনামূলক নতুন পরিচালক। আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যদি আমাদের ছবিটার জন্য ভাল কিছু করতে পারি, অবশ্যই তা করব। একজন অভিনেত্রী হিসাবে সেটা আমার দায়বদ্ধতা।

এত কিছু করেও যদি ব্যর্থতা মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়?

তা হলে সেটা থেকেও শিখব। শেখা থামালে চলবে না। তবে আমার কাছে বাণিজ্যিক সাফল্যই সব নয়। শিল্পী হিসাবে যদি কোনও কাজ আমাকে আত্মতুষ্টি দেয়, সেটাকে আমি সাফল্য হিসাবেই ধরব।

‘কন্যা’ হিসাবে নিজেকে কতটা সফল মনে হয়?

(একটু ভেবে) আমি তো নিজেকে দশে দশই দেব। হয়তো জীবনে অনেকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। আমার জন্য হয়তো তাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু মা-বাবার জন্য আমি একশো শতাংশ সব কিছু করার চেষ্টা করেছি। কতটা করতে পেরেছি, সেটা তাঁরাই বলবেন। কিন্তু অনেকে এই চেষ্টাটুকুও করেন না। সেই নিরিখে নিজেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখব।

কেরিয়ারের শুরুতেই ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-এর মতো সাফল্য দেখেছেন। বাংলা ছবির সেই সময়টাকে মিস করেন?

না। কারণ এখন বাংলায় অনেক ধরনের গল্প তৈরি হচ্ছে। ওটিটি-র সুবাদে সকলে সব ধরনের গল্প বলতে পারছেন। দর্শকের কাছে তা বদলে দেওয়াও সহজ হয়ে গিয়েছে। এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ বেড়েছে। আগে ৬০-৬৫ দিন ধরে শুটিং হত। এখন সেটা কমে ১৫-২০ দিন হয়ে গিয়েছে। সেটা মিস করি। তবে সময়ের সঙ্গে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তণও দেখলাম।

কী?

ফিল্মের শুটিং থেকে ডিজিটালে শুট হওয়া। এক সময় ফিল্মের ক্যামেরায় হাতেগোনাই কয়েকটা রিল থাকত। আমি যদি একটাও এনজি শট দিই, তা হলে আমার জন্য খরচ বেড়ে যাবে— এই বিষয়টা মাথায় থাকত। সেটা খুব ভাল ট্রেনিং দিয়েছে আমায়। আর সেই সময়ও কিন্তু বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক ছবি হয়েছে। আমি নিজেই কেরিয়ারের শুরুতে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ করেছি। তিনি অন্য ধারার ছবি তৈরির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু তখন এই ধরনের ছবি খুব একটা দর্শকের সামনে আসার সুযোগ পায়নি। এখন কিন্তু সব ছবি সমান ভাবে সেই সুযোগটা পাচ্ছে। দর্শকও আরও বেশি অপশন পাচ্ছেন।

পুজোতেও এবার প্রচুর অপশন! ‘রঘু ডাকাত’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ নাকি ‘রক্তবীজ ২’— কোনটার জন্য আপনি মুখিয়ে?

(সজোরে হেসে) এই রে! এটা কী করে বলি, ইন্ডাস্ট্রিতে তো আমায় টিকে খেতে হবে! ওঁরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। সব কটা ছবি নিয়েই তাই সমান আগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা, দর্শক পুজোর সময় হল ভরিয়ে ছবি দেখবেন। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!

আপনার সমসাময়িক মিমি চক্রবর্তী, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় পর্দায় ছকভাঙা অ্যাকশন করছেন। আপনি কবে শামিল হচ্ছেন সেই তালিকায়?

বিশ্বাস করুন, আমিও করতে চাই! এরকম প্রস্তাব দিলেই করব। সেই অপেক্ষাতেই আছি।