প্রয়াত ভারতীয় বিজ্ঞাপন দুনিয়ার তারকা পীযূষ পাণ্ডে। শুক্রবার প্রয়াত হলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। গত বেশ কিছুদিন ধরে সংক্রমণে ভুগছিলেন এই বিজ্ঞাপন-দুনিয়ার জাদুকর। শনিবার সম্পন্ন হবে তাঁর শেষকৃত্য। প্রায় চার দশক ধরে বিজ্ঞাপনের জগতে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন পীযূষ পাণ্ডে। ছিলেন ওগিলভি ইন্ডিয়ার এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান (ইন্ডিয়া) ও চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার (ওয়ার্ল্ডওয়াইড)।

বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন বছর ২৭-এর পীযূষ। ১৯৮২ সালে ওগিলভিতে যোগ দিয়ে সূর্যোদয় ডিটারজেন্টের জন্য লিখেছিলেন তাঁর প্রথম বিজ্ঞাপন। ছয় বছর পর তিনি প্রবেশ করেন কোম্পানির ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টে, আর তারপরই একে একে জন্ম দেন ইতিহাস গড়া বিজ্ঞাপনগুলো -ফেভিকলের ‘জোড় ইসসে টুট না সাকে’, ক্যাডবেরির ‘কুছ মিঠা হো যায়ে’, ‘এশিয়ান পেইন্টস’, ‘লুনা মোপেড’, ‘ফর্চুন অয়েল’ -সব জায়গাতেই তাঁর কলমে উঠে এসেছে ভারতীয় জীবনের সহজ-সরল রঙ। তাঁর নেতৃত্বে ওগিলভি ইন্ডিয়া টানা ১২ বছর দেশের সেরা বিজ্ঞাপন সংস্থা হয়ে ওঠে ।
তা ঠিক কোথায় ছিল পীযূষ পাণ্ডের এই সাফল্যের রহস্য? ঠিক কোন রেসিপির গুণে আসমুদ্রহিমাচল ভারতে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠত তাঁর তৈরি বিজ্ঞাপনগুলো? আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে নিজের ভাবনা ভাগ করে নিলেন এক সময়ের বাংলার বিজ্ঞাপন জগতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব রংগন চক্রবর্তী। ‘বোরোলীন’, ‘শালিমার’-এর বিখ্যাত বিজ্ঞাপনগুলোর জিঙ্গেলসগুলি রচনা করেছিলেন তিনি।
ভারবর্ষের মতো একটা বড় দেশে, যে দেশে বিজ্ঞাপনের জগতটা এত বড়, সেখানে এই ক্ষেত্রে এক নম্বরে কার নাম রয়েছে জানতে চাওয়া হলে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাঁর নাম উঠে আসত, তিনি পীযূষ পাণ্ডে। এটা কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয়। কারণ এত বড় দেশে সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁকে এক নম্বর বলে মেনে নিতেন। এটা মোটেই সহজ কথা নয়। রাজস্থানের লোক ছিলেন। উত্তর ভারতের যে ভাষা, মানে খানিকটা রাজস্থানি, খানিক হিন্দি মানে এককথায় দেশজ ভাষাকে বিজ্ঞাপনের জগতে নিয়ে আসেন। এবং আটের দশক থেকে তিনি যে কাজটা শুরু করেছিলেন, তা ভারতীয় বিজ্ঞাপনকে আমূল বদলে দেয়। আসলে, বিজ্ঞাপন দেশে এসেছিল প্রথমত বিদেশি পণ্যের প্রচারের জন্য। সেই সময়ে বাংলাতে আমরা ভাল ভাল কিছু বিজ্ঞাপন দেখেছি কারণ যেহেতু ইংরেজদের সমর্থনে বাঙালিরা অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিল। সেই সময় সত্যজিৎ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়...সব মিলিয়ে মিশিয়ে বাংলার বিজ্ঞাপন জগৎ ছিল দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সহজ কথায়, ভারবর্ষের বিজ্ঞাপনের রাজধানী। এরপর আটের দশকে যখন বাণিজ্যিক ছবির উত্থান হল, তখন আস্তে আস্তে কলকাতা থেকে বিজ্ঞাপনের জগৎ মুম্বইয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসল, তখন এই যে ‘শিফট’ - তার থেকে প্রেরণা নিয়ে যাঁরা উঠে এলেন, সেই ওগিলভি সংস্থা, তা সামলেছিলেন পীযূষ।
“পীযূষের বহু বিজ্ঞাপনের ক্যাম্পেন আজও এক উচ্চারণে বলে দেয় মানুষজন। যেমন, ফেভিকলের বাসের মাথায় আঁটোসাঁটো করে বসা যাত্রীরা, ক্যাডবেরির বিজ্ঞাপনে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়া সেই ক্যাডবেরি গার্ল, এশিয়ান পেইন্টসের বিজ্ঞাপনের অবিস্মরণীয় সেই লাইন- " হর ঘর কুছ কেহতা হ্যায়'-এর কথা জানি। এরকম আরও বহু বহু বিজ্ঞাপন আছে। একজন মানুষ খুব সফল, খ্যাতি পেয়েছেন, প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন-সব ঠিক আছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাঁর যে ছাপ সেটির গুরুত্ব তাঁর মূল্যায়নে সবথেকে বেশি হয়। ভারতীয় বিজ্ঞাপনে নতুন ভাষা তৈরি করা পীযূষ পাণ্ডের সবথেকে বড় অবদান। তবে উনি একা নন, ওঁর ভাই প্রসূন পাণ্ডেও ওঁর সহযোগী ছিলেন এসব ক্ষেত্রে। যিনি বিজ্ঞাপনের ছবিগুলি বানিয়েছিলেন। আরেকজন ছিলেন, প্রসূন যোশী এখন যে সেন্সর বর্ডার প্রধান। এই প্রসূন যোশী-ও কিন্তু পীযূষের কাছে কাজ শিখেছিলেন, পরে গীতিকার হিসেবেও নিজের কেরিয়ার গড়েন। এঁরা সবাই বিজেপি দলের ঘনিষ্ঠ, সেটাও ওঁদের জনপ্রিয়তা তৈরি করার ক্ষেত্রে একটা অনুঘটকের কাজ করেছিল। এও শুনেছি, মোদীর যে জনপ্রিয়তা, এই যে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ক্যাম্পেন...সেসবের পিছনেও নাকি পীযূষ এবং প্রসূনের অবদান আছে।
যাই হোক, আর একটা কথা। যখন প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের রমরমা ছিল, তখন লেখার উপর জোর দেওয়া হত বেশি। পীযূষ পাণ্ডে যে যুগে এলেন, তখন ভারতে টেলিভিশনের রমরমা শুরু হয়ে গিয়েছে। ওঁরা বিজ্ঞাপন তৈরির ক্ষেত্রে মূলত ছবি, ইমেজ, আইডিয়ার উপরে জোর দিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞাপন চলে ক্যাচি লাইন দিয়ে। কিন্তু স্রেফ লাইন দিয়ে বিজ্ঞাপন চলে না, মনে রাখার মতো হয় না। বিজ্ঞাপন চলে আইডিয়ার উপরে এবং পীযূষের যে এই আইডিয়াগুলো, এই ভিস্যুয়ালগুলোর মধ্যে ছিল খাঁটি ভারতীয়ত্ব। এবং একটা বিজ্ঞাপনে চটি ফেটে যাচ্ছে, বাসে এমন ভিড় যে গাদাগাদি করে যাচ্ছে আর দুলতে দুলতে যাচ্ছে -এই যে গরিব মানুষের সমস্যাগুলোকে ব্যঙ্গ না করেও যে পজিটিভভাবে নিয়ে আসা যায় বিজ্ঞাপনে সহমর্মিতার সঙ্গে, সেসব আমরা শিখেছি পীযূষ পাণ্ডের থেকে। যদিও আমার আর ওঁর কেরিয়ার শুরু একই সময়ে, তবুও। সেসব দেখে আমরা অবাকও হয়েছি। আসলে, এটা আমরা পারতামও না। কেন পারতাম না? কারণ, এসবের মধ্যেও একটা রাজনীতি আছে। কারণ যখন কলকাতায় বড় হয়ে উঠছি, বামপন্থা বাংলার রাজনীতির প্রভাবে আমরা যেভাবে সমাজটাকে অসম সমাজ হিসেবে দেখি, সবকিছুকে পলিটিক্যালি দেখি বলে সমস্যা হয়। উনি সেভাবে দেখতেন না। পীযূষ সেই সমাজের অসাম্যটাকেও মজা করে দেখতে পারতেন! একটা বোধের তফাৎ আর কী।”
