আজকাল ওয়েবডেস্ক: যে কোনও বড় অস্ত্রোপচার বা অপারেশনের আগে রোগীদের এক অমোঘ নির্দেশ মেনে চলতে হয়- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছুই খাওয়া বা পান করা চলবে না। অনেক সময়েই এই সময়টা আট থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। এই নিয়ম নিয়ে রোগী এবং তাঁর পরিজনদের মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে। কেন এই কড়াকড়ি? খালি পেটে শরীরে শক্তি কম থাকে, তাহলে অপারেশনের মতো একটি ধকল শরীর নেবে কী করে? অনেকেই হয়তো ভাবেন, এটা নিছকই একটি প্রথাগত নিয়ম। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এই নির্দেশের পিছনে রয়েছে জীবনরক্ষার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সামান্য অবহেলা বা ভুল এক্ষেত্রে মারাত্মক, এমনকি প্রাণঘাতী বিপদ ডেকে আনতে পারে।
মূল কারণ: অ্যানেস্থেসিয়া এবং তার প্রভাব
বড় অস্ত্রোপচারের সময়ে রোগীকে সম্পূর্ণ অচেতন বা অজ্ঞান করার জন্য অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এই অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধগুলি কেবল মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়িয়ে দেয় না, শরীরের সমস্ত মাংসপেশিকে শিথিল করে দেয়। এর মধ্যে আমাদের খাদ্যনালী এবং শ্বাসনালীর সংযোগস্থলের পেশিগুলিও থাকে।
সাধারণ অবস্থায়, আমাদের খাদ্যনালীর উপরের দিকে একটি ভাল্ভ বা কপাটিকার মতো পেশি (ইসোফেগাল স্ফিংটার) থাকে, যা পাকস্থলী থেকে খাবার বা অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে উঠে আসতে বাধা দেয়। এছাড়াও আমাদের শ্বাসনালীর মুখে থাকা প্রতিরোধ ব্যবস্থা যে কোনও অবাঞ্ছিত বস্তু ফুসফুসে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু অ্যানেস্থেসিয়ার প্রভাবে এই সমস্ত পেশি এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই খাবার খাদ্যনালী থেকে ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে।
‘পালমোনারি অ্যাসপিরেশন’-এর মারাত্মক ঝুঁকি
যদি অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে রোগীর পাকস্থলী খাবার বা পানীয়ে ভরা থাকে, তবে অচেতন অবস্থায় সেই খাবার খাদ্যনালী বেয়ে উপরে উঠে আসতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘রিগারজিটেশন’। যেহেতু অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে শ্বাসনালীর রক্ষাকবচ নিষ্ক্রিয় থাকে, তাই সেই উঠে আসা খাদ্যকণা, পানীয় বা পাকস্থলীর অ্যাসিড খুব সহজেই শ্বাসনালীতে ঢুকে ফুসফুসে পৌঁছে যেতে পারে।
এই ঘটনাকে বলা হয় ‘পালমোনারি অ্যাসপিরেশন’। এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পাকস্থলীর অ্যাসিড ফুসফুসের নরম কোষগুলিকে পুড়িয়ে দেয়, যার ফলে তীব্র রাসায়নিক প্রদাহ বা নিউমোনাইটিস হয়। এর পাশাপাশি, খাদ্যকণার মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়, যা ‘অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া’ নামে পরিচিত। এর ফলে রোগীর শ্বাসযন্ত্র সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যেতে পারে এবং রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: পেশি ফোলাতে স্তনদুগ্ধ খাচ্ছেন বডিবিল্ডাররা, প্রাপ্তবয়স্কদের এই দুধ কতটা উপকারী? কী বলছে বিজ্ঞান?
চিকিৎসকদের সতর্কতা
অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা জানাচ্ছেন, এটি অস্ত্রোপচারের আগে নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতাগুলির মধ্যে একটি। যদি কোনও রোগী ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলেন, তাঁর জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে অস্ত্রোপচার স্থগিত করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। রোগীর সুরক্ষাই আসল।
সাধারণত, অস্ত্রোপচারের অন্তত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা আগে থেকে কঠিন খাবার বন্ধ করতে বলা হয়। চা, কফি বা দুধের মতো পানীয়ও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে অস্ত্রোপচারের ২-৩ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বচ্ছ পানীয় (যেমন জল) পানের অনুমতি অনেক সময় দেওয়া হয়, যা নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং অস্ত্রোপচারের ধরনের উপর।
সুতরাং, পরের বার যখন কোনও চিকিৎসক আপনাকে বা আপনার পরিচিত কাউকে অপারেশনের আগে খালি পেটে থাকতে বলবেন, তখন জানবেন, এই আপাত কষ্টকর নিয়মটি আসলে আপনার ফুসফুসকে সুরক্ষিত রেখে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে মসৃণ এবং নিরাপদ করার জন্যই তৈরি হয়েছে। এটি মেনে চলা রোগীর অবশ্য কর্তব্য।
