আজকাল ওয়েবডেস্ক: বয়সের ভারে হোক বা দুর্ঘটনা কিংবা অন্য কোনও রোগে- দাঁত পড়ে গেলে ভরসা বলতে সেই কৃত্রিম দাঁতের পাটি বা ‘ডেনচার’, নয়তো অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ ‘ডেন্টাল ইমপ্ল্যান্ট’। কিন্তু কেমন হয় যদি ফাঁকা মাড়িতেই ফের গজায় একেবারে নতুন, ঝকঝকে স্বাভাবিক দাঁত? যা এতদিন ছিল নিছকই কল্পবিজ্ঞানের বিষয়, তাকেই এ বার বাস্তবের দোরগোড়ায় নিয়ে এলেন জাপানি বিজ্ঞানীরা। কিয়োটো ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এমন এক যুগান্তকারী ওষুধের সন্ধান পেয়েছেন, যার প্রয়োগে ফোকলা মাড়িতেই নতুন দাঁত গজানো সম্ভব। ইঁদুর ও ফেরেটের (বেজি জাতীয় প্রাণী) উপর প্রয়োগ অভাবনীয় সাফল্য মিলেছে এই ওষুধে। সম্প্রতি মানুষের উপর সেই ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগও (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) শুরু হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই আবিষ্কার সফল হলে তা দন্তচিকিৎসার দুনিয়ায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে আর কৃত্রিম দাঁতের উপর নির্ভর করতে হবে না।

আরও পড়ুন: বাতের ব্যথা সারাতে বাঘের মূত্র পান করছে চিনারা! প্রতিবেশী দেশের কাণ্ডে ছিছিক্কার বিশ্বজুড়ে

এই গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন কিয়োটো ইউনিভার্সিটির প্রখ্যাত গবেষক ডক্টর কাতসু তাকাহাশি। তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষক দলটি একটি বিশেষ প্রোটিনকে চিহ্নিত করেছে, যার নাম ‘ইউএসএজি-১’। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই প্রোটিনটি আমাদের শরীরে দাঁতের বিকাশ বা বৃদ্ধিকে দমন করে রাখে। অর্থাৎ, দাঁত গজানোর প্রক্রিয়ায় এটি একটি ‘ব্রেক’-এর মতো কাজ করে। ডক্টর তাকাহাশি এবং তাঁর সহকর্মীরা এমন একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ওষুধ তৈরি করেছেন, যা নির্দিষ্টভাবে এই ইউএসএজি-১ প্রোটিনকে খুঁজে বার করে তাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ‘ব্রেক’টি সরিয়ে দিলেই দাঁতের বৃদ্ধি বা গজানোর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ফের সক্রিয় হয়ে ওঠার কথা। এই তত্ত্ব হাতে পেয়েই গবেষকরা পুরোদমে ল্যাবরেটরিতে কাজে নামেন। ২০১৮ সালে তাঁরা প্রথম বড়সড় সাফল্য পান। ইঁদুরের উপর এই অ্যান্টিবডি ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখা যায়, তাদের মুখে সত্যিই নতুন দাঁত গজাচ্ছে। কিন্তু ইঁদুরের দাঁতের গঠনের সঙ্গে মানুষের দাঁতের গঠনের বেশ কিছুটা অমিল রয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে চাইলেন, মানুষের ক্ষেত্রেও এটি কাজ করবে কি না। পরবর্তী ধাপে তাঁরা বেছে নেন ‘ফেরেট’কে। এই প্রাণীটির দাঁতের গঠন এবং দাঁত প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া মানুষের সঙ্গে অনেকটাই মেলে। ফেরেটের উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করেও একই রকম আশাতীত সাফল্য মেলে। দেখা যায়, তাদের মাড়িতেও গজিয়েছে নতুন, সম্পূর্ণ দাঁত। ইঁদুর এবং ফেরেটের উপর এই দ্বৈত সাফল্য বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাঁরা মানুষের উপর এই চিকিৎসার ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। গবেষণাকে ল্যাবরেটরি থেকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং ওষুধটিকে দ্রুত বাজারে আনতে ২০২৪ সালে 'তোরেগেম বায়োফার্মা’ নামে একটি স্টার্টআপ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থাটিই কিয়োটো ইউনিভার্সিটির গবেষণার ভিত্তিতে ওষুধটি তৈরি ও ট্রায়ালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে। তোরেগেম বায়োফার্মা সূত্রে খবর, চলতি বছরেই মানুষের উপর প্রথম পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হয়েছে। এই পর্বে, সম্পূর্ণ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবকদের উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই পর্বের মূল লক্ষ্য হল, ওষুধটি মানুষের শরীরে কতটা নিরাপদ এবং এর কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। এই সুরক্ষা পরীক্ষা সফল হলে, গবেষকদের পরবর্তী লক্ষ্য হল সেই সব শিশুদের উপর এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা, যারা জন্মগতভাবে দাঁতের অভাবে ভোগে। অনেক শিশুরই জন্ম থেকে সবকটি দাঁত গজায় না, এই চিকিৎসা তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। ডক্টর তাকাহাশি এবং তোরেগেম বায়োফার্মার গবেষকরা অত্যন্ত আশাবাদী। তাঁদের পরিকল্পনা, যদি সমস্ত ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন হয়, তবে ২০৩০ সালের মধ্যেই এই চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণ মানুষের নাগালে আনা সম্ভব হবে।