আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৪ সালের জুন মাস। গাজার কেন্দ্রীয় নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ১৩ বছরের মাযিউনা দামুর জীবনে ঘটে যায় এক অকল্পনীয় বিপর্যয়। ইজরায়েলের এক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ল তাদের বাড়ির উপর। মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল তাদের আশ্রয়। বিস্ফোরণের অভিঘাতে মাযিউনা ও তাঁর মা ছিটকে পড়েন রাস্তায়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ছোট বোন তালাকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও, তাঁর অন্য দুই ভাইবোন—হালা (১৩) ও মোহান্নাদ (১০)—সেই মুহূর্তেই মারা যায়। মাযিউনা বেঁচে যায়, কিন্তু অর্ধেক মুখ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়; নিচের চোয়ালের হাড় পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এখন মাযিউনা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এল পাসো শহরে চিকিৎসাধীন, যেখানে তিনি ধীরে ধীরে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। গাজা যুদ্ধের এই দীর্ঘতম রাত্রিতে তাঁর বেঁচে ওঠার গল্প যেন এক আশার আলো। কিন্তু এই পুনরুদ্ধার সহজ ছিল না—বরং প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি।
গাজার হাসপাতালগুলো তখন ছিল গুলিতে, বোমায় ও অবরোধে বিধ্বস্ত। উন্নত পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচার করা সেখানে ছিল অসম্ভব। মাযিউনার বাবা-মা বারবার ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে মানবিক চিকিৎসা পারমিট চেয়ে আবেদন করেন, যাতে মেয়েকে বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো যায়। কিন্তু একের পর এক আবেদন হয় উপেক্ষিত, নয় প্রত্যাখ্যাত। এসময় তাঁর ক্ষত ক্রমে সংক্রমিত হতে থাকে, মুখের ভেতরে শেল বা ধাতব টুকরো ঢুকে অজস্র যন্ত্রণার কারণ হয়।
অবশেষে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি হয়। চাপে পড়ে ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁকে চিকিৎসার অনুমতি দেয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে মাযিউনা, তাঁর মা আর বেঁচে যাওয়া বোন তালা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। সেখানেই এল পাসো চিলড্রেনস হসপিটালে শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা।
প্রায় এক বছর হয়ে গেল তাঁরা ফ্র্যাঙ্কলিন পর্বতের পাদদেশে একটি নিরিবিলি, সবুজ-গাছে ঘেরা রাস্তায় নতুন জীবনের সূচনা করেছেন। ধীরে ধীরে তাঁরা চেষ্টা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে। মাযিউনা ও তালা স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে, এবং গাজার যুদ্ধের কারণে হারানো এক বছরের পড়াশোনা আবার শুরু করতে কঠোর পরিশ্রম করছে।
যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে আসে, মাযিউনা একটিও ইংরেজি জানত না। এখন সে সাবলীলভাবে ইংরেজি বলে, এমনকি কিছুটা স্প্যানিশও শিখে ফেলেছে। তার এখন নতুন স্বপ্ন—“আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই, যেন আমার মতো আহত শিশুদের সাহায্য করতে পারি। আমি ভাগ্যবতী যে বেঁচে গিয়েছি এবং চিকিৎসা পেয়েছি। একদিন আমিও অন্যদের তেমন সাহায্য করতে চাই, যেমন এখানে ডাক্তাররা আমাকে করেছেন,” জানিয়েছে মাযিউনা।
গত এক বছরে মাযিউনার একাধিক বড় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। প্রধান সার্জন ডা. আরশাদ কালিম বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য মাযিউনার মুখের মৌলিক গঠন ও সৌন্দর্য পুনর্গঠন করা। এটি একটি বহু-ধাপের দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কারণ সে এখনও বেড়ে উঠছে—তাই প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের পরিকল্পনা বদলাতে হবে।”
ইতিমধ্যেই তাঁর গাল, ঠোঁট এবং ভেঙে যাওয়া চোয়ালের পুনর্গঠন সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাযিউনার মুখের ক্ষতস্থানগুলিতে কৃত্রিম হাড় ও ত্বক প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তিনি এখন খাওয়া, পান করা ও কথা বলায় আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পরবর্তী ধাপে তাঁর দাঁতের স্থায়ী ইমপ্লান্ট বসানো হবে, যখন তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি স্থিতিশীল হবে। আপাতত তাঁকে আংশিক কৃত্রিম দাঁতের প্রস্থেটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে।
মাযিউনার মা, আরিজ দামু বলেন, “প্রথমে আমি ভয় পেতাম, ওর মুখ দেখে অন্য বাচ্চারা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার পর ও আবার হাসতে শুরু করেছে। ওর আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। এখন ওর চোখে আমি ভবিষ্যতের আলো দেখতে পাই।”
এক শরতের বিকেলে, তাদের বাড়ির উঠোনে দেখা যায়—মাযিউনা ও তালা দু’জনে লাল ও কালো রঙের ঐতিহ্যবাহী থোব পরে নাচছে। তাদের পোশাকজুড়ে সূচিকর্ম করা রয়েছে প্রাচীন তাত্রিজ নকশা—যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্যালেস্তাইনের মহিলারা ব্যবহার করে এসেছেন নিজেদের ইতিহাস, প্রতিরোধ ও ভালোবাসার গল্প বলার জন্য।
গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে যুক্তরাষ্ট্রের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা মাযিউনার জীবন তাই একদিকে যেমন অবর্ণনীয় কষ্টের গল্প, তেমনই মানবিক সংহতির এক দৃষ্টান্তও বটে। তাঁর মুখে আজও রয়ে গেছে যুদ্ধের দাগ—কিন্তু চোখে আছে বেঁচে থাকার দীপ্তি, আর একদিন অন্যদের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার।
