আজকাল ওয়েবডেস্ক: সাইবেরিয়ার জমাটবদ্ধ পারমাফ্রস্টের গভীর থেকে বিজ্ঞানীরা যখন প্রাচীন মৃত্তিকা গলিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন, তখন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা চোখে পড়ে। হাজার হাজার বছর ধরে বরফের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নেমাটোড বা কৃমিরা ধীরে ধীরে নড়াচড়া করতে শুরু করে — যেন তারা এক দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে! গবেষণাগারে সামান্য উষ্ণতা পেতেই এই অণুজীবেরা পুনরায় জীবনপ্রক্রিয়া শুরু করে।


এই ঘটনাটি শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহলই নয়, বহু ব্যবহারিক প্রশ্নও উত্থাপন করেছে। যেমন— ঠিক কত বছর তারা সেখানে ছিল? কীভাবে তারা এত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারল? এমন জীববিজ্ঞান কি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে জীবিত কোষ বা টিস্যু দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে?


বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী, যে পারমাফ্রস্ট স্তরে এই কৃমিগুলি পাওয়া গেছে, সেটি শেষ বরফ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বরফে জমে ছিল। সেখানে হাজার বছরের শীতল, শুষ্ক ও অক্সিজেন-স্বল্প পরিবেশ কোষ ও DNA-এর রাসায়নিক ক্ষয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর করে দেয়।

আরও পড়ুন:  প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে চাঞ্চল্যকর চুরি, বন্ধ হল বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত জাদুঘর


এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ফিলিপ শিফার যিনি জার্মানির University of Cologne-এর জীববৈচিত্র্য জিনোমিক্স বিশেষজ্ঞ। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা জার্মানির ড্রেসডেন শহরের গবেষকদের সঙ্গে মিলে এই প্রাচীন কৃমির জিনোম বা বংশগত নকশা বিশ্লেষণ শুরু করেন। কারণ, সরাসরি প্রাণীটির বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব নয় — এতে জীবিত দেহের ক্ষতি হতে পারে বা তাতে নতুন কার্বনের মিশ্রণ ঘটতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা একই গহ্বর বা সুড়ঙ্গে পাওয়া উদ্ভিদের টুকরো-টাকরো পরীক্ষা করেন। রেডিওকার্বন ডেটিংয়ে দেখা যায়, ওই উদ্ভিদাংশের বয়স প্রায় ৪৬,০০০ বছর। অর্থাৎ এই নেমাটোডরা প্লেইস্টোসিন যুগের বাসিন্দা!


বিস্তারিত জিনোম বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিফার ও তাঁর দল নির্ধারণ করেন যে এটি একেবারেই নতুন প্রজাতির কৃমি। এই কৃমির জিনোমে দেখা গেছে তিন সেট ক্রোমোজোম বা ত্রিগুণ গঠন। এটি সাধারণত এমন প্রাণীতে দেখা যায় যারা পুরুষ ছাড়াই প্রজনন করে। 


তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল— তারা কীভাবে এত দীর্ঘ সময় টিকে ছিল? গবেষকরা লক্ষ্য করেন, যদি এই কৃমিদের হিমায়িত করার আগে কিছুটা সময় শুকিয়ে নেওয়া হয়, তারা একটি বিশেষ জীবরক্ষা অবস্থায় প্রবেশ করে। এই অবস্থায় তারা সমস্ত জীবনপ্রক্রিয়া বন্ধ রেখে “ঘুমিয়ে” যায়, ফলে -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও টিকে থাকতে পারে।


সাইবেরিয়ান পারমাফ্রস্ট তাদের বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ দেয়— স্থিতিশীল ঠান্ডা তাপমাত্রা, অত্যন্ত কম আর্দ্রতা এবং সীমিত অক্সিজেন, যা তাদের জীবনীশক্তিকে হাজার বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখে।


শিফার ও তাঁর দল যখন এই নতুন প্রজাতির জিনোমের সঙ্গে সুপরিচিত কৃমির জিন তুলনা করেন, তারা দেখেন যে উভয় প্রজাতির মধ্যেই জিনগুলো একরকম। অর্থাৎ প্রকৃতি বহু সহস্র বছর আগেই এমন এক জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, যা মৃত্যুর সীমানাকেও অতিক্রম করে জীবনকে স্থগিত রাখতে পারে।


এই আবিষ্কার শুধু পৃথিবীর প্রাচীন জীবনের রহস্য উন্মোচনই নয়, বরং ভবিষ্যতে চিকিৎসা, জিন সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানে জীববৈজ্ঞানিক সংরক্ষণের নতুন সম্ভাবনা খুলে দিতে পারে।