আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেরই একটি মাত্র রাজধানী শহর রয়েছে। কিছু দেশে দুটি রাজধানী থাকলেও, পৃথিবীতে একমাত্র দেশ যার তিনটি রাজধানী রয়েছে—সেই দেশটি হল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই অনন্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রতিটি রাজধানী আলাদা সরকারি শাখার প্রতিনিধিত্ব করে, যার মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা সমানভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে বণ্টিত হয়েছে।
তিন রাজধানীর ধারণা: এক দেশের তিন মুখ
দক্ষিণ আফ্রিকার তিন রাজধানী হল—প্রিটোরিয়া, কেপ টাউন এবং ব্লুমফন্টেইন। এই তিনটি শহর দেশের তিনটি প্রধান সরকারি কার্যাবলী পরিচালনা করে—প্রশাসনিক, আইন প্রণয়ন ও বিচারিক।
এই তিন রাজধানীর ব্যবস্থা চালু হয় ১৯১০ সালে, যখন ব্রিটিশরা চারটি আলাদা উপনিবেশকে একত্রিত করে গঠন করে ইউনিয়ম সাউথ আফ্রিকা। প্রতিটি প্রদেশই চেয়েছিল রাজধানীর মর্যাদা পেতে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে ক্ষমতা তিন শহরে ভাগ করে দেওয়া হয়, যাতে কোনো একটি অঞ্চল অত্যধিক প্রভাবশালী না হয়ে ওঠে।
প্রশাসনিক রাজধানী – প্রিটোরিয়া
প্রিটোরিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার প্রশাসনিক রাজধানী। এখানেই রয়েছে রাষ্ট্রপতির দফতর, মন্ত্রিসভা, এবং বেশিরভাগ সরকারি মন্ত্রণালয়। বিদেশি দূতাবাসগুলোর বড় অংশও প্রিটোরিয়াতেই অবস্থিত, যা একে দেশের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। প্রিটোরিয়া গাউতেং প্রদেশে অবস্থিত এবং এটি দক্ষিণ আফ্রিকার দৈনন্দিন শাসন ও প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এখানে ঐতিহাসিকভাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা দক্ষিণ আফ্রিকার আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছে।
আরও পড়ুন: চাঁদের গায়ে হঠাৎই ‘অজানা আলো’, চিন্তায় ঘুম ছুটেছে বিজ্ঞানীদের
আইন প্রণয়ন রাজধানী – কেপ টাউন
কেপ টাউন দক্ষিণ আফ্রিকার আইন প্রণয়ন রাজধানী, অর্থাৎ এখানেই দেশের পার্লামেন্ট বা সংসদ বসে। এটি বিশ্বের অন্যতম মনোরম শহর, যার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত টেবিল মাউন্টেন এবং সামনে প্রসারিত আটলান্টিক মহাসাগর। পার্লামেন্টের অবস্থান কেপ টাউনে রাখার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। আজও কেপ টাউন দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবিধানিক ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
বিচারিক রাজধানী – ব্লুমফন্টেইন
ব্লুমফন্টেইন হল দক্ষিণ আফ্রিকার বিচারিক রাজধানী। এখানেই অবস্থিত সুপ্রিম কোর্ট অফ অ্যাপিল। এটি দেশের অন্যতম উচ্চতম আদালত। যদিও দেশের সাংবিধানিক আদালত জোহানেসবার্গে রয়েছে, তবুও ব্লুমফন্টেইন আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগের কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। শহরটি তার শান্ত পরিবেশ ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আইনব্যবস্থার ঐতিহ্যের প্রতীক।
তিন রাজধানীর কারণ: ইতিহাস ও ঐক্যের প্রতীক
দক্ষিণ আফ্রিকার তিন রাজধানীর এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক সমঝোতার ফল। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন দেশটি একত্রিত করে, তখন প্রতিটি অঞ্চলই রাজধানী হওয়ার দাবি জানায়। তাই ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রশাসনিক কেন্দ্র রাখা হয় প্রিটোরিয়ায়, আইন প্রণয়নের কেন্দ্র কেপ টাউনে, আর বিচার বিভাগীয় কেন্দ্র ব্লুমফন্টেইনে।
এই তিন রাজধানী ব্যবস্থা শুধু ক্ষমতার বণ্টনের প্রতীক নয়, বরং “ঐক্যে বৈচিত্র্য”-এর প্রতিফলন। দক্ষিণ আফ্রিকার ১২টি সরকারি ভাষা, অসংখ্য সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার জন্য এই ব্যবস্থা এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
দক্ষিণ আফ্রিকার তিন রাজধানী ব্যবস্থা দেখায় কিভাবে একটি দেশ ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে ঐক্য রক্ষা করতে পারে। প্রিটোরিয়া, কেপ টাউন ও ব্লুমফন্টেইন—এই তিন শহর শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার বহুসাংস্কৃতিক পরিচয় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক।
