আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২১ সালের জুন মাস। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর চের্তানোভো এলাকার এক বহুতলের ফ্ল্যাটে সকাল ছয়টার সময় ঘুম ভাঙল সাংবাদিক রোমান বাদানিনের। দরজার ঘণ্টা বাজছিল অবিরাম। দরজা খুলতেই চোখের সামনে দৃশ্য দেখে স্তব্ধ তিনি—রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির ছয় থেকে আটজন আধিকারিক, সবাই সাদা পোশাকে, একজনের হাতে তল্লাশি পরোয়ানা। এরপর প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে বাদানিনের দুই ঘরওয়ালা ফ্ল্যাট ও তাঁর স্ত্রীর গাড়ি তছনছ করে তল্লাশি চালানো হয়। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায় এবং চার ঘণ্টা টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এই আচরণ দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো তিনি কোনও আর্থিক কেলেঙ্কারি বা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত। কিন্তু প্রকৃত সত্য ছিল ভিন্ন। বাদানিনের “অপরাধ” একটাই — তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘অবৈধ কন্যা’র সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। বাদানিন জানান, “রাশিয়ায় পুতিনের ব্যক্তিগত জীবন একেবারে নিষিদ্ধ বিষয়। সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবাদ আছে — ‘তার পরিবারের বিষয়ে হাত দিও না।’”
বর্তমানে বাদানিন স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী মিখাইল রুবিন মিলে সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন একটি বই — ‘The Tsar Himself: How Vladimir Putin Deceived Us All’। বইটিতে পুতিনের ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম ও পরকীয়া নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: বন্ধুত্বের মুখোশ ঝেড়ে ফের স্বমহিমায় ট্রাম্প! ভারতের উপর আবারও 'ব্যাপক' শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি
বইয়ে দাবি করা হয়েছে, পুতিন যদিও বিশ্বের সামনে নিজেকে ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেন, বাস্তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তিনি নানান তরুণী, নর্তকী ও স্ট্রিপারদের সান্নিধ্যে সময় কাটাতেন।
কেজিবি থেকে ক্ষমতার রাজপথে
পুতিনের কর্মজীবনের শুরু সোভিয়েত ইউনিয়নের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি থেকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর রাজনীতিতে যোগ দেন এবং তিন বছরের মধ্যেই সেন্ট পিটার্সবার্গের উপমেয়র হন। তখনই তাঁর স্ত্রী লিউদমিলার সঙ্গে বিবাহিত জীবন চলছে, তাঁদের দুই কন্যাও রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে পুতিনের পথ ছিল একেবারে ভিন্ন।
“লুনা” ক্লাবের গোপন আসর
বইয়ে লেখা আছে, সে সময় পুতিন নিয়মিত যেতেন সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি স্ট্রিপ ক্লাবে, যার নাম ছিল লুনা। দ্বিতীয় তলায় ছিল তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষ, যেখানে নর্তকীদের সঙ্গে ‘বিশেষ সময়’ কাটাতেন তিনি। ক্লাবটি পরিচালনা করত এক অপরাধচক্র, যার সঙ্গে পুতিনের তৎকালীন দেহরক্ষী রোমান সেপভের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
সাফাইকর্মী থেকে কোটিপতি
পুতিনের প্রথম বহুল আলোচিত সম্পর্ক ছিল স্বেতলানা ক্রিভোনোগিখ নামে এক সাফাইকর্মীর সঙ্গে। ১৯৯৯ সালে এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়, যখন পুতিন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট পদে ওঠার দৌড়ে রয়েছেন। চার বছর পর তাঁদের কন্যা এলিজাভেতা বা লুইজা রোজোভার জন্ম হয়। ২০২০ সালে প্রোজেক্ট নিউজপোর্টালে বাদানিনের দল এই তরুণীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। তরুণীর মুখাবয়বে পুতিনের সঙ্গে আশ্চর্য মিল দেখা যায়। এমনকি তাঁর নামের মধ্যবর্তী অংশ “ভ্লাদিমিরভনা”— যা পুতিনের নামের প্রতি ইঙ্গিতবহ।
২০০৩ সালে এলিজাভেতার জন্মের পর স্বেতলানা মোনাকোতে প্রায় ২.৯ মিলিয়ন পাউন্ডে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। ২০২১ সালে ফাঁস হওয়া Pandora Papers থেকে জানা যায়, তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৭৮ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি — যা এক প্রাক্তন সাফাইকর্মীর আয়ে সম্ভব নয়।
অলিম্পিক জিমন্যাস্ট কাবায়েভার সঙ্গে সম্পর্ক
২০০৪ সালে পুতিনের জীবনে আসেন আলিনা কাবায়েভা—এথেন্স অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকে স্বর্ণপদকজয়ী এক তরুণী। ম্যাক্সিম ম্যাগাজিনের জন্য তাঁর নগ্ন ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, যা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। তাঁর কোচ ইরিনা ভিনার (অলিগার্ক আলিশার উসমানভের স্ত্রী) পুতিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। ২০০৬ সাল নাগাদ তাঁদের সম্পর্ক শুরু হয় বলে দাবি করা হয়েছে।
২০০৮ সালে মস্কোর এক ট্যাবলয়েড Moskovsky Korrespondent খবর প্রকাশ করে যে, পুতিন ও কাবায়েভার বিয়ে হতে চলেছে। খবর প্রকাশের পরই সংবাদপত্রের অফিসে এফএসবি হানা দেয়। সম্পাদক গ্রিগরি নেখোরোশেভকে জেরা করা হয় এবং পরে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। শেষমেশ সরকারচাপের কারণে সংবাদপত্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে কাবায়েভা দুই সন্তানের মা—ইভান ও ভ্লাদিমির। ২০১৪ সালে তাঁকে জাতীয় মিডিয়া গ্রুপের প্রধান করা হয়, যেখানে তাঁর বার্ষিক বেতন প্রায় ৭.৭ মিলিয়ন পাউন্ড।
দাম্পত্যের ভাঙন ও নতুন বিতর্ক
পুতিনের স্ত্রী লিউদমিলার সঙ্গে সম্পর্ক বহু আগেই তিক্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি স্বামীর দীর্ঘ কর্মঘণ্টা নিয়ে অভিযোগ করে এক বন্ধুকে বলেন, “ও যেন ভ্যাম্পায়ার।” অবশেষে ২০১৩ সালে তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং ২০১৪ সালে তা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়।
কিন্তু তাতেও শেষ হয়নি পুতিনের বিতর্কিত সম্পর্কের কাহিনি। ২০১০ সালে প্রকাশিত এক যৌন আবেদনময়ী ক্যালেন্ডারে ১৭ বছর বয়সি এক ছাত্রী আলিশা খারচেভার সঙ্গে সম্পর্কের গুজব ছড়ায়। শোনা যায়, কিছুদিন পরেই ওই তরুণী মস্কোর শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বিলাসবহুল আবাসনে থাকতে শুরু করেন।
প্রেম, ক্ষমতা ও অর্থ
বইটিতে বাদানিন ও রুবিনের দাবি—পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বিবাহ একটি “অবাধ প্রতিষ্ঠান”, যেখানে একাধিক সম্পর্ক ও প্রতারণা স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁরা লিখেছেন, “প্রত্যেক নারী তাঁর সাফল্য ও সম্পদের জন্য পুরুষের উপর নির্ভরশীল।”
নির্বাসনে বাদানিন
২০২১ সালের ঘটনার পর বাদানিন মরক্কোতে ছুটিতে যান। সাহারায় ইন্টারনেটহীন কয়েকদিন কাটানোর পর জানতে পারেন, তাঁকে রাশিয়ায় “অবাঞ্ছিত ব্যক্তি” ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি বুঝেছিলাম রাশিয়ায় ফিরলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে।” পরে তাঁর স্ত্রী রাশিয়ায় ফিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসেন, আর পরবর্তী দেড় মাসে তাঁদের প্রায় দশজন সহকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
সব মিলিয়ে, এক তরুণীর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশের জন্য যে তাণ্ডব নেমে আসে, তা শুধু বাদানিনের নয়—সমগ্র রুশ সাংবাদিক সমাজের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা। ক্রেমলিনের তরফে অবশ্য এখনও পর্যন্ত এই বই বা বাদানিনের অভিযোগ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে আলোড়ন পড়েছে এই প্রশ্নে—রুশ প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত জীবনের অনুসন্ধান কি সত্যিই রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ?
