আজকাল ওয়েবডেস্ক: যে দেশের মানুষরা এতদিন ‘মশাবিহীন’ বলে গর্ব করতেন, সেই আইসল্যান্ডের দুর্গেও শেষ পর্যন্ত হানা দিল মশা। শুনে চক্ষু চড়কগাছ হলেও, সম্প্রতি এই খবরেই সিলমোহর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও আইসল্যান্ডের হ্রদ বা জলাশয়ে এখনও মশার বংশবৃদ্ধি শুরু হয়নি, তবে উড়োজাহাজে চেপে ‘আগন্তুক’ মশার প্রবেশ যে শুরু হয়েছে, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাই কপালে ভাঁজ ফেলেছে পরিবেশবিদদের। তাঁদের আশঙ্কা, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে যদি দ্বীপরাষ্ট্রটির আবহাওয়া বদলাতে থাকে, তবে মশার উপদ্রবে ছেয়ে যেতে খুব বেশি দেরি নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন আইসল্যান্ডে মশা নেই? ভূগোল ও জীববিজ্ঞানের এক আশ্চর্য খেয়ালে আইসল্যান্ড ছিল পৃথিবীর একমাত্র মশা-মুক্ত দেশ। এর কারণ লুকিয়ে আছে দেশটির খামখেয়ালি আবহাওয়ার মধ্যে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মশার জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থির জলের প্রয়োজন হয়, যেখানে লার্ভা থেকে পিউপা দশায় রূপান্তরিত হতে পারে তারা। আইসল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশগুলিতে (যেমন নরওয়ে বা গ্রিনল্যান্ড) তীব্র শীত পড়লেও গ্রীষ্মে বরফ গলে জলাশয় তৈরি হয় এবং মশা বংশবৃদ্ধি করে।
কিন্তু আইসল্যান্ডের আবহাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে শীতের পর যখন বরফ গলতে শুরু করে, ঠিক তখনই আচমকা আর এক দফা শৈত্যপ্রবাহ ফিরে আসে। ফলে জলাশয়গুলি ফের জমে বরফ হয়ে যায়। এই খামখেয়ালি আবহাওয়ার ফলে মশার লার্ভা পিউপা দশায় পৌঁছনোর আগেই মারা পড়ে। ফলে তাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণ হয় না। তা ছাড়া, আইসল্যান্ডের মাটি ও জলের রাসায়নিক গঠনও মশার বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল নয় বলে মনে করা হয়।
তবে এই অভেদ্য দুর্গেই হানা দিয়েছে আধুনিক সভ্যতা। আইসল্যান্ডের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেফ্লাভিকে প্রথমবার মশার উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। আশির দশকে একটি উড়োজাহাজের কেবিন থেকে একটি মশা ধরে ফেলেন বিজ্ঞানীরা। সেই মশাটিকে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে রেইকিয়াভিকের ‘আইসল্যান্ডিক ইনস্টিটিউট অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’-এর সংগ্রহশালায়। এটি এডিস প্রজাতির মশা ছিল।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এখন আর এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক উড়ান যত বাড়ছে, ততই যাত্রীদের মালপত্রের সঙ্গে বা বিমানের কেবিনে লুকিয়ে মশার আইসল্যান্ডে প্রবেশের আশঙ্কা বাড়ছে। সম্প্রতি কয়েকটি গবেষণাপত্রেও এই ‘অনুপ্রবেশ’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই আগন্তুক মশারা বাইরে বংশবৃদ্ধি করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু বিপদ ঘনাচ্ছে অন্য দিক থেকে।

পরিবেশবিদদের মতে আসল আতঙ্ক জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আইসল্যান্ডের গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। শীতের তীব্রতা কমছে, খামখেয়ালি আবহাওয়াও স্থিতিশীল হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারি, পরিস্থিতি এ ভাবে বদলাতে থাকলে এমন একটা সময় আসবে যখন আইসল্যান্ডের জলাশয়গুলি মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ হয়ে উঠবে। যদি কোনও ভাবে কয়েকটি মশা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে স্থানীয় পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে, তবেই বিপদ।
আপাতত আইসল্যান্ড ‘মশাবিহীন’ তকমা ধরে রাখলেও, এই বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি অদূর ভবিষ্যতের জন্য এক স্পষ্ট সতর্কবার্তা। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে এই দ্বীপরাষ্ট্রেও যে মশার গুনগুনানি শোনা যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান নন বিজ্ঞানীরা।
