বুড়োশিব দাশগুপ্ত
যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা-ই হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির আলিঙ্গনের ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হবে এমনটাই আশা করেছিলেন সকল। কিন্তু হল ঠিক উল্টোটা। আমেরিকায় রপ্তানি করা সমস্ত ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ৮০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য বিপর্যয়। বস্ত্র, চামড়াজাত পণ্য, রত্ন ও অলংকার এবং চিংড়ি বাণিজ্যের মতো আমেরিকায় রপ্তানি করে এমন ভারতীয় শিল্পগুলি ধসে পড়বে। যার ফলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং জিডিপি বৃদ্ধির উপর বড় প্রভাব পড়বে।
ট্রাম্প হঠাৎ করে ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠলেন কেন? তার বেশ কিছু তত্ত্ব রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি তাঁর কারণেই হয়েছে, দাবি করেছেন ট্রাম্প। যদিও ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি অস্বীকার করে বলেছে কোনও তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়নি। নরেন্দ্র মোদির এই অস্বীকার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষুব্ধ করেছিল। দ্বিতীয় কারণ হল রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করতে ভারতের রাজি না হওয়া। যার ফলে প্রায় সমস্ত অন্যান্য দেশের উপর পূর্বের ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পাশাপাশি দ্বিতীয়বার ভারতের উপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক জরিমানা আরোপ করা হয়েছিল।
যদিও বেশ কয়েকজন আমেরিকান ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে ভারতের রাশিয়ান তেল আমদানি কেবল একটি অজুহাত। ভারত আমেরিকার কাছে রাশিয়া বা চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঠিক তাই করেছেন। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য ভারতকে ত্যাগ করেছেন। আমেরিকা চীনের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ স্থগিত রেখেছে। আমেরিকা চীনা ওষুধ এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যদি আমেরিকা সরাসরি চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নত করতে পারে (অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে কিছু সহায়তায়), তাহলে ভারতকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণই নেই ট্রাম্পের কাছে। ভারত আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল কারণ তারা চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে ভারতকে একটি প্রতিরোধ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। যদি বিশ্বের দু’টি বৃহত্তম অর্থনীতি- আমেরিকা এবং চীন ‘বন্ধু’ হতে পারে, তাহলে ভারতের জন্য চিন্তা করে কে?
আরও পড়ুন: ভারতীয় অর্থনীতি কি সত্যিই ‘মৃত’?
বিশ্ব কূটনীতি ভবিষ্যদ্বাণীর উপর নির্ভর করে না, বরং স্বার্থের উপর নির্ভর করে। ট্রাম্পের আপাত অযৌক্তিকতা এই নিয়মের সঙ্গে ঠিক খাপ খায়: আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে অন্যদের অনুমান করতে দিন। ট্রাম্প কৌশল পরিবর্তন করছেন: তিনি পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং প্রয়োজনে তিনি রাশিয়ার পক্ষ লাভের জন্য ইউক্রেনকে ত্যাগ করতে পারেন। চীনের সঙ্গে, আমেরিকা তার ‘দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি’র পরিবর্তন করতে চায়: দু’টি বিশাল অর্থনীতি একে অপরের উপর নির্ভরশীল; রাজনৈতিকভাবে শত্রুতা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রাজনৈতিকভাবে, আরও ভাল ব্যবসা করার জন্য নিরপেক্ষ থাকাই ভাল। ভারতকে, আমরা যতই উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে কল্পনা করি না কেন, সে তিনটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের গভীর এবং অনিশ্চিত ভূ-রাজনীতির মধ্যে হেরে গিয়েছে।

ভারত এখন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের বিদেশনীতি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। তাদের বাণিজ্যের নতুন ক্ষেত্রগুলি অন্বেষণ করতে হবে এবং আমেরিকার সঙ্গে স্বাভাবিক সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল না হয়ে কাজ করতে হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে; মোদী শীঘ্রই সাংহাই সম্মেলনের (এসসিও) জন্য চীন সফর করবেন এবং জাপান সফরে যাবেন। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও জোরদার হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমি দেশগুলির দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে রাশিয়ার সন্দেহ দূর করা দরকার।
ভারতের কাঠামোগত সংস্কারের আরও গভীরে যাওয়ার সময় এসেছে। এমনকি ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মীরাও এখন খোলাখুলিভাবে বলতে সাহস পাচ্ছেন যে ভারতের ‘ব্যবসা সহজ করার’ নীতি তুচ্ছ সরকারি নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী একবার গম আমদানির ক্ষেত্রে পিএল৪৮০ নিয়মের মাধ্যমে আমেরিকান ব্ল্যাকমেইলকে অমান্য করেছিলেন এবং সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলেন। এই পরিবর্তন আনার জন্য তাঁকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একইভাবে, ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও মনমোহন সিংহের সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতিকে চিরতরে বদলে দিয়েছিলেন।
এখন আরও একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের সময় এসেছে। ট্রাম্পের যন্ত্রণা আমাদের শিক্ষা দেবে। ভারী শুল্কের জন্য ভারতকে রক্তপাত করতে হবে। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য ছাড়া সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা কঠিন- এমনকি চীনও তা করবে না। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি (প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও), ভারতের আরও সরবরাহ শৃঙ্খল অন্বেষণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, প্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে।
