বুড়োশিব দাশগুপ্ত

কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী পীযুষ গয়াল গত ছয় মাস ধরে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তির সই করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিশেষ সাফল্য পাননি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (বিটিএ) সম্পন্ন করার জন্য ভারতীয় হাইকমিশনের লবি জোরদার করার জন্য তিনি প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর দলের সঙ্গে আমেরিকা সফর করছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে, পাঁচটি প্রধান ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন এবং ঘোষণা করা হয়েছে।  কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিটি এখনও ঝুলে রয়েছে। সমস্যা কোথায়?

যে দু’টি ক্ষেত্র নিয়ে বিতর্ক তা হল কৃষি এবং অটোমোবাইল। আমেরিকা ভারতের কৃষি বাজারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার চায়। ভুট্টা, সোয়াবিন, তুলা, , দুগ্ধ এবং হাঁস-মুরগির মতো পণ্যের জন্য। ভারত তার দেশীয় কৃষক, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি উদারীকরণের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার বিষয়ে যথাযথভাবে সুরক্ষিত। আমেরিকা এই বাজারে শুল্ক হ্রাস এবং অবাধ প্রবেশাধিকার চায়। জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) খাবারও উদ্বেগের বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় (সামগ্রিকভাবে ৩.৩%, কৃষিতে ৫%) ভারতের শুল্ক হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি (সামগ্রিকভাবে ১৭%, কৃষি পণ্যের উপর ৩৯%) এবং আমেরিকা সেই শুল্কের হার আরও কমানোর চেষ্টা করছে। ট্রাম্প প্রায় একযোগে ভারতের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছেন, যা ২০২৪ সালে ছিল ৪৫.৭ বিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন: আহমেদাবাদ বিপর্যয়ের পরে কি বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করবে এয়ার ইন্ডিয়া?

ভারতের সংরক্ষণবাদী নীতি, যার লক্ষ্য ছিল দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা (যেমন 'মেক ইন ইন্ডিয়া'), আমেরিকার উন্মুক্ত বাজারের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। ভারত এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইন্দিরা গান্ধীর পিএল ৪৮০ সময়কাল অতিক্রম করে এসেছে অনেক আগেই, যখন ভারতকে তার জনগণের খাদ্যের জন্য আমেরিকার থেকে গম আমদানির উপর নির্ভর করতে হত। তাই এটা বাস্তব যে ভারতকে আলোচনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কারণ ভারতীয় কৃষিতে আমেরিকার পদার্পণের ফলে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি হতে পারে। যার ফলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

আমেরিকা-ভারত বাণিজ্য চুক্তি বিলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিরোধের বিষয় হল অটোমোবাইল সেক্টর। যা মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের অধীনে ভারতে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করে থাকে। ভারত গাড়ির ধরণের উপর নির্ভর করে (যেমন সিবিইউ বা সম্পূর্ণরূপে নির্মিত ইউনিট) ৬০ থেকে ১০০% পর্যন্ত উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছে। অন্য কথায়, ভারতে আমেরিকান গাড়ি আমদানি করতে হলে ১০০% কর দিতে হয়। যার ফলে ভারতীয় বাজারে আমেরিকান গাড়ির প্রবেশ সহজ নয়। আমরা ভারতীয়রা রাস্তায় জাপানি, কোরিয়ান এমনকি জার্মান গাড়িও দেখতে পাই কারণ তারা ভারতে গাড়ি তৈরি করে কিন্তু আমেরিকান গাড়ি দেখি না কারণ আমেরিকা এখানে গাড়ি তৈরি করে না। আগে জেনারেল মোটরস হিন্দুস্তান মোটরসের সঙ্গে সহযোগিতায় ভারতে গাড়ি প্রস্তুত করত। কিন্তু এখন আর তার অস্তিত্ব নেই।

আরও পড়ুন: ইলন মাস্কের 'আমেরিকা পার্টি' কি বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারবে?

ইলন মাস্ক ভারতে টেসলা গাড়ি (বৈদ্যুতিক সংস্করণ) তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি তাঁর সুখের দিন অতীত এবং ট্রাম্প সরকারের কাছ থেকে তিনি কোনও সুবিধা পাবেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সম্ভবত, অটোমোবাইলের উপর শুল্ক কমানোর জন্য ভারতের একটি শর্ত হবে আমেরিকাকে ভারতে আমেরিকান গাড়ি তৈরি করতে বাধ্য করা। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ট্রাম্প এখনও কোনও 'শর্ত' ছাড়াই তাঁর শুল্ক কমানোর বিষয়ে অনড়।

আমেরিকা ভারতের অনেক ‘অ-শুল্ক’ বাধা যেমন মান নিয়ন্ত্রণ আদেশ (Quality Control Orders বা QCO) নিয়েও আপত্তি জানাচ্ছে। যা মার্কিন রপ্তানির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা বলেছে, এটি ভারতের সুরক্ষাবাদ নীতি। এপ্রিলের আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছিল যখন ১৯টি পণ্যের জন্য শর্তাবলী চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ভারত হিমায়িত মাংস এবং কিছু কৃষিপণ্যের উপর শুল্ক কমাতে সম্মত হয়েছিল। খসড়ায় ‘ফরোয়ার্ড মোস্ট ফেভারড নেশন’ ধারাটিও চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সবকিছুই আটকে গিয়েছিল ট্রাম্পের ভারতীয় কৃষি বাজার উন্মুক্ত করার এবং অনেক কম শুল্কে আমেরিকান গাড়ি রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার দাবিতে। উভয় ক্ষেত্রেই এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় হতে পারে।