কৃশানু মজুমদার: মা আমায় চারখানা রুটি দিলেন। আমার বরাবরই মনে হয়, সকলের থেকে মা আমাকেই বেশি ভালবাসেন। রাত্রে নিশ্চয় না খেয়ে আমার জন্য রুটি রেখে দিয়েছেন। অন্য সময় এই নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দিতাম, আজ করলাম না। সাতটার মধ্যে মাঠে পৌঁছতে হবে। নিমাই আর আনোয়ার বটতলা বাস স্টপে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে।
বেরোবার সময় মাকে হঠাৎ প্রণাম করলাম। ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে খেলতে যাচ্ছি না, ট্রায়াল দিতে যাচ্ছি মাত্র। যদি বিপিন সিংহের পছন্দ হয়, তা হলে ময়দানের ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগ আসবে। ফুটবল আমার কাছে রূপকথার একটা প্রাসাদ। যে আশা মনে মনে বহু দিন ধরে লালন করে আসছি, আজ তার দরজায় পৌঁছোতে যাচ্ছি মাত্র। যদি ঢুকতে পারি, তা হলে এক একটা তলা নীচে ফেলে উপরতলায় উঠবই, উঠতেই হবে। সে জন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, করবই। মা আমাকে বুকে চেপে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ”খোকা, মন দিয়ে চেষ্টা করবি।”

কিট ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে যখন বটতলার দিকে যাচ্ছি, তখন মনের মধ্যে মা’র কথাটাই গুনগুন করছিল। মন দিয়ে কেন, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, মা সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন, ওঁকে সুখী করবই।
সাদার্ন সমিতির সমীর বায়েন মতি নন্দীর কালজয়ী সৃষ্টি 'স্ট্রাইকার' পড়েছেন কিনা জানা নেই, কিন্তু তাঁর কথা শুনতে শুনতে 'স্ট্রাইকার'-এর প্রসূনের কথাই মনে পড়ে যায়। স্মৃতিতে হানা দেয় উপন্যাসের উপরের ওই লাইনগুলো।
প্রসূন তো গল্পের চরিত্র। কিন্তু সমীর রক্তমাংসের। কলকাতা লিগে সাত-সাতটা ম্যাচ খেলে ফেলেছেন তিনি। গোল করেছেন চারটি। সাদার্নের কোচ সুজাতা কর বলছেন, ''ছেলেটার মধ্যে প্যাশন রয়েছে। ফুটবল খেলে এগিয়ে যেতে চায়। যা বলি, তাই শোনে।''
স্ট্রাইকারদের পৃথিবীতে গোলই শেষ কথা। একটা গোল দিয়ে যায় পরিচিতি। একটা গোল মুহূর্তে এনে দিতে পারে খ্যাতি-যশ। পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসে স্ট্রাইকার। কলকাতা লিগে ইউনাইটেড কলকাতা স্পোর্টিং ক্লাব, শ্রীভূমি ও পিয়ারলেসকে গোল দিয়ে সমীর বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি গোল করতেই এসেছেন।
নোয়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের কাছেই সমীরের বাড়ি। বাবা রাজমিস্ত্রি। মা পরিচারিকার কাজ করেন। দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দাদা পেট্রোল পাম্পের কর্মী। সমীর বলছেন, ''দাদা চাকরি করছে বলেই আমি ফুটবল খেলতে পারছি।'' বিখ্যাত খেলোয়াড়দের জীবনে তাঁদের দাদাদের ভূমিকা অপরিসীম। এই দাদা-ভাই জুটির নতুন আখ্যান কি পড়বে ভাবীকাল? সময় উত্তর দিয়ে যাবে।
সমীর জানে, এই ফুটবল তাঁর অভাবের সংসারেএনে দিতে পারে অর্থের জোগান। মা-বাবাকে সুখ এনে দিতে পারে এই চর্মগোলক। সাদার্নের স্ট্রাইকার এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন, ''জানেন আমি মুরগির দোকানে বসে মুরগি কেটেছি টাকার জন্য। মাছের দোকানে কাজ করেছি। গাড়ি চালিয়ে তিনশো-চারশো টাকা রোজগার করেছি। এখন ফুটবল খেলে যা টাকা পাই তা বুট কেনার পিছনেই চলে যায়। বাড়িতে আমি কিছুই দিতে পারি না।''

তাঁর জীবনযুদ্ধের কাহিনি শুনতে শুনতে ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীর এক সাক্ষাৎকার মনে পড়ে যায। সুনীল বলছিলেন, ''অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আমার খেলায় যারা আসে, তাদের বেশিরভাগই আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ঘরের। ওরা জানে আমাকে দাঁড়াতে হলে ফুটবল খেলেই বড় হতে হবে। ফুটবল ওদের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন। ফুটবল ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারে হাসি, ভুলিয়ে দিতে পারে কান্না।''
ফিরে আসি সমীরের গল্পে। দিদির বিয়ের সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তাঁর মা। সেই সময়ের গল্প বলতে বলতে সমীরের গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে আবেগ। নিত্যিদিনের জীবনে রয়েছে ঘর্মাক্ত পরিশ্রমের গল্প। সূর্য উঠতেই শুরু হয়ে যায় সমীরের মা-বাবার কর্মচাঞ্চল্য। তাঁরা বেরিয়ে পড়েন কাজে।
বাস্তবের স্ট্রাইকার বলে চলেন, ''লিগের খেলা থাকলে আমি বাড়ি থেকে খেয়ে যেতে পারি না। ক্লাবে চলে যাই খাওয়ার জন্য। দুপুরে ক্লাবে খেয়ে সাদার্নের বাসে করেই মাঠে যাই।''
কোচ সুজাতা তাঁর শিষ্য সম্পর্কে বলছেন, ''ওর মধ্যে খিদে রয়েছে। ওই খিদেই ওকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।'' সমীরের রয়েছে গোলের খিদে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা লিগের সুপার ডিভিশনে বেলঘরিয়া অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে ৯টা গোল করেছেন এবার।
স্থানীয় মাঠে তাঁকে খেলতে দেখেই বর্ষীয়ান কোচ সুশান্ত গুহ চিনেছিলেন 'জহর'। কোচিং জীবনের ২৮টা বসন্ত পার করা সুশান্তবাবু বলছেন, ''বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাই আমার নেশা। সমীরকে দেখে আমার ভাল লেগেছিল। ওকে বেলঘরিয়া অ্যাথলেটিক ক্লাবে নিয়ে আসি। কলকাতা মাঠে আমার হাত ধরেই প্রথম খেলে গরলগাছায়। তার পর আমার কোচিংয়ে ঐক্য সম্মিলনীতে খেলেছে। এখন খেলছে সাদার্নে। এবছর জেলা লিগে ৯টা গোল করেছে। ছেলেটা গোল চেনে। গোল করে চলেছে। সন্তোষ ট্রফির জন্য বাংলা দলে সমীরকে ডাকা উচিত।''

মতি নন্দীর স্ট্রাইকার প্রসূন গোল করে ঘাস আর মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধ বুক ভরে নিয়েছিলেন। সমীরও গোল করে জীবনযুদ্ধে নায়ক হতে চান। স্বপ্ন দেখেন শরীরের দোলায় একে একে কেটে যাচ্ছে তাঁর আর্থিক দুরবস্থা, মা-বাবার দুঃখ-দুর্দশা। এই ফুটবলই যে তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস। তাঁর বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
আরও পড়ুন: এশিয়া কাপে মুখোমুখি ভারত-পাক, বোর্ডের নীতির সমালোচনায় আজহার
