আজকাল ওয়েবডেস্ক: যুগ যুগ ধরে সমর্থকদের আবেগ প্রকাশের মঞ্চ গ্যালারি। আবেগ-শোক-আনন্দ একইসঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটে এখানে। আগের থেকেও এখন রঙিন কংক্রিটের এই ভূখণ্ড। এখনও সেখানে রয়েছে গান, রয়েছে প্রতিবাদ।
এই গ্যালারি দেখেছে মেক্সিকান ওয়েভ, ভুভুজেলা! আবার সেখান থেকেই দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বার্তা। কখনও সেখানে দেখা গিয়েছে এনআরসি-প্রতিবাদ। লেখা হয়েছে, ''রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়।''
আবার কখনও গর্বের সংস্কৃতি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ''রসগোল্লা কিন্তু আমাদের, বুঝলে ভায়া।'' বুধবার ইস্টবেঙ্গল-নামধারী ম্যাচে দেখা গেল প্রতিবাদী এক ব্যানার। লাল-হলুদ সমর্থকরা সম্মিলিত ভাবে সোচ্চার হলেন সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। নিজেদের অবস্থান তুলে ধরলেন রক্ত গরম করা এক ব্যানারের মাধ্যমে।
ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষায় কথা বললেই ভিনরাজ্যে আক্রান্ত হচ্ছেন বাঙালিরা। তাঁদের বাংলাদেশি বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। জুটছে মারধর। সম্প্রতি বাংলাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে উল্লেখ করে বসে দিল্লি পুলিশ। প্রশ্ন উঠছে বাঙালি অস্মিতা কি আজ বিপন্ন! এ নিয়ে উদ্বিগ্ন লাল-হলুদ ভক্তরা। এর প্রতিবাদেই এক ব্যানার মাঠে নিয়ে এলেন তাঁরা। সেই ব্যানারে লেখা, ''ভারত স্বাধীন করতে সেদিন পড়েছিলাম ফাঁসি! মায়ের ভাষা বলছি বলে, আজকে বাংলাদেশী?''
লাল-হলুদ ফ্যান ক্লাব 'ইস্টবেঙ্গল আলট্রাস' সেই ব্যানারের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে লিখেছে, ভারত স্বাধীন করতে সেদিন পড়েছিলাম ফাঁসি! মায়ের ভাষা বলছি বলে, আজকে বাংলাদেশী? চারিদিকে ঘটে চলা তীব্র বাঙালি বিরোধী কাজকর্মে ক্ষতবিক্ষত আমাদের হৃদয়। এ ভাষা কবিগুরুর ভাষা, এ ভাষা সুভাষচন্দ্র বোসের ভাষা, এ ভাষা বিদ্যাসাগরের ভাষা .. আর কত নাম বলবো! কিন্তু বর্তমানে এ ভাষা ব্যবহারকারীদের কি সহজেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য দেশের নাগরিক বলে; জুটছে অত্যাচার, লাঞ্ছনা। অথচ এটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা! স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিদান দেওয়া সেই মানুষদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যা কম নয় অথচ তাদের মাতৃভাষার সম্মান আজ ভূলুন্ঠিত।
এমতাবস্থায় আমরা চুপ থাকি কি করে! যে ভাষায় জন্মের পর পাই প্রথম মাতৃস্নেহের ডাক তার এহেন অপমানে মুখ বুজে থাকলে তা হয় বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। তাই চুপ আমরা থাকছিনা। আর কেনই বা থাকবো? বাকিদেরও জানাই আহ্বান। এগিয়ে আসুন, গর্জে উঠুন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
'আমরা হলাম যুদ্ধবাজ, মাঠের বাইরেও করবো রাজ
লড়াই করে দেখিয়ে দেবো, বাঙালির স্পর্ধা আজ'।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। দিন সাতেক হবে। মুর্শিদাবাদ জেলার হরিহরপাড়ার শামিম শেখ দীর্ঘদিন ধরেই মুম্বইয়ের থানেতে শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় কথা বলার 'অপরাধে' চূড়ান্ত অসম্মানিত-অপমানিত হন তিনি। মীরা রোড থানার পুলিশ তুলে নিয়ে যায় শামিমের মতো বাংলাভাষী শ্রমিকদের। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁদের টাকাপয়সা। আটকে রাখা হয় বন্দি শিবিরে। বেঁধে রাখা হয় দুটো হাত। জোটে মারধর। বৈধ নথি থাকলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় সীমান্তের ওপারে। বাংলাদেশে।
শামিম শেখের মতোই মারাত্মক পরিণতি হয় ইসলামপুরের সাব্বিরেরও। কাজ করতে গিয়েছিলেন ভিনরাজ্যে। বাংলায় কথা বলার জন্য কর্মক্ষেত্র থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ভেঙে দেওয়া হয় পা। ভাঙা দুটো পা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন সাব্বির। হেনস্থার ভয়ে অটো নিয়ে গুরুগ্রাম থেকে মালদহে চলে এসেছেন দুই ভাই। দেশ জুড়ে দেখা দিচ্ছে বাঙালি বিদ্বেষ।
দিন যত এগোচ্ছে এই ভয়াবহতা আরও বাড়ছে। বেড়েই চলেছে নির্যাতিত বাঙালির সংখ্যা। সেই সঙ্গে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ভয়। রাজ্যের শাসকদল পথে নেমেছে, আশঙ্কিত বিদ্বজ্জনরা। কিন্তু পরিস্থিতি কি বদলাচ্ছে? বেরিয়ে আসছে কি সমাধানসূত্র? নিত্যিদিন এহেন নির্যাতন, এহেন বিদ্বেষের ভয়াবহ কাহিনি নিয়ে কালি খরচ হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে।
ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল মোহনবাগান। খালি পায়ে মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক শিল্ড জয় কেবল ফুটবল ম্যাচ ছিল না। তা ছিল এক স্বাধীনতার যুদ্ধও। দিনকাল এখন বদলেছে। কিন্তু খেলার মাঠ তার স্বভাব বদলায়নি। বদলায়নি চরিত্র।
ফুটবল হোক বা ক্রিকেট, মাঠ এমন এক তীর্থক্ষেত্র যেখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ, রং সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। উঠে আসে উদ্ভাবনী সব চিন্তাধারা। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাও প্রতিভাত হয় সেখানে। বৃহত্তর কোনও দিনের ডাক দিয়ে যায় খেলার সবুজ মাঠ। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল বুধসন্ধ্যার যুবভারতীতে।
ইস্টবেঙ্গল-নামধারীর লড়াই হল মাঠে। সেখানে দেখা গেল ট্যাকটিক্যাল কচকচানি। দেখা গেল স্কিলের বিচ্ছুরণ। গ্যালারিতে দেখা গিয়েছে প্রতিবাদী ব্যানার। অনুরণিত হয়েছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বাঙালি আবেগের ফল্গুধারা বয়েছে সেখানে। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য যে অসম্মান-নিপীড়নের কাহিনি লেখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রতিটা দিন, তা মেনে নিতে পারেননি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। গর্জে ওঠার মঞ্চ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে যুবভারতীর গ্যালারি।
আরও পড়ুন: ম্যাচের সেরা ফুটবলারকে ঠেলা গাড়ি ভর্তি আলু, এমন অভিনব পুরস্কারের কথা আগে শুনেছেন আগে? ...
