আজকল ওয়েবডেস্ক: কলকাতার ফুটবলে ‘পাহাড়ি বিছে’ কথাটা বেশ পরিচিত। পাহাড় থেকে নেমে ফুটবলের মক্কা কলকাতায় খেলতে আসা সফল ফুটবলাররা এই তকমা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন একাধিকবার। যেমন ভাইচুং ভুটিয়া। কলকাতার মাঠে তাঁর দাপুটে পারফরম্যান্সই তাঁকে এই তকমা এনে দেয়। ভাইচুং-জমানা এখন ইতিহাস ঠিকই। কিন্তু পাহাড়ি বিছেরা এখনও আছে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের নানা দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তাঁরা।
মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, সিকিমের পাহাড় থেকে সমতলে নেমে ভারতের বিভিন্ন শহরে ফুটবলপ্রেমীদের মন মাতাচ্ছেন, এমন ফুটবলার এখন অনেকই রয়েছে বিভিন্ন দলে। তবে তাঁদের মধ্যে অবশ্যই একটি উজ্জ্বল নামনাওরেম মহেশ সিং। আইএসএলে যোগ দেওয়ার পর থেকে ইস্টবেঙ্গল এফসি তাদের সমর্থকদের গর্বিত করতে না পারলেও এই তারকা মিডফিল্ডার কিন্তু বরাবরই লাল-হলুদ সমর্থকদের আনন্দ দিয়েছেন, গর্বিতও করেছেন।
ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ভারতীয় খেলোয়াড় বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তা হলে তিনি অবশ্যই নাওরেম মহেশ সিং। তাঁর সতীর্থদের পারফরম্যান্সের রেখচিত্রে ওঠা-নামা রয়েছে অনেক। কিন্তু মহেশের পারফরম্যান্স-গ্রাফ বেশিরভাগ সময়েই থেকেছে উর্ধ্বমুখী। ফলে আইএসএলে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি দিন ধরে খেলছেন (১৪১২ দিন)। এই ইস্টবেঙ্গল দলে তিন বছরের জন্য চুক্তি বাড়ানো হয়েছে এই একজন ভারতীয়েরই।
আরও পড়ুন: দুই ওভারে দুই হ্যাটট্রিক, ৫ জন বোল্ড, বিরল কীর্তি বাঙালি স্পিনারের
২০২১-এর অগাস্টে মহেশ লিয়েনে কেরালা ব্লাস্টার্স থেকে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন। ২০২২-এ তিনি কলকাতার দলের সঙ্গে পাকাপাকি চুক্তিবদ্ধ হন। তারপর থেকে লাল-হলুদ শিবিরেই রয়ে গিয়েছেন তিনি। ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন নিজের সেরাটুকু দিয়ে। স্টিফেন কনস্টান্টাইন থেকে কার্লস কুয়াদ্রাত, অস্কার ব্রুজোনদের প্রত্যেকের মুখেই মহেশের ভূয়ষী প্রশংসা শোনা গিয়েছে। তাঁর প্রাক্তন ব্রাজিলীয় সতীর্থ এবং ইস্টবেঙ্গলের তারকা ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভাও তাঁর প্রশংসা করেছেন একাধিবার। ধারাবাহিক ভাবে দলকে লড়াকু হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন মহেশ। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতের অভাবে সে ভাবে দলকে সফল করে তুলতে পারেননি। অনেকের অভিযোগ, তাঁর মতো একজন অসাধারণ ফুটবলার ইস্টবেঙ্গলে থেকে গিয়ে নিজের ফুটবল জীবনের ক্ষতি করেছেন। কিন্তু মহেশ কখনও তা মানতে চাননি।

ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ ইগর স্টিমাচেরও প্রিয় ছিলেন মহেশ। তাঁর আমলেই, ২০২৩-এ মায়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলিতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় মহেশের। তার পর থেকে ভারতের হয়ে ২৫টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তিনটি গোল করেছেন, দু’টি অ্যাসিস্টও করেন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিরুদ্ধে একটি গোল করেন ও একটি করতে সাহায্য করেন।
আইএসএলেও তাঁর অ্যাসিস্টের সংখ্যা ১০। গোলও করেছেন দশটি। ১০৫টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। গোলের লক্ষ্যে রাখা তাঁর শটের সংখ্যা (২৫) লক্ষ্যভ্রষ্ট শটের (২৪) চেয়ে বেশি। একজন মিডফিল্ডার হিসেবে এই পরিসংখ্যান অনুসরণ করার মতো। আইএসএলের এক মরশুমে ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট করার নজিরও রয়েছে তাঁর দখলেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহেশের এই পারফরম্যান্স কাজে লাগাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল।
ইস্টবেঙ্গলের কঠিন সময়ের মধ্যেও ধারাবাহিকভাবে লাল-হলুদ সমর্থকদের মুখে হাসি এনে দিয়েছেন মহেশ। কেরালা থেকে কলকাতায় এসে মহেশ শুধু উন্নতি করেননি—তিনি প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। উইংয়ে তাঁর দৃষ্টিনন্দন খেলা, পাস দেওয়ার তীক্ষ্ণ চোখ এবং নিরলস পরিশ্রম তাঁকে দেশের সেরা উইঙ্গারদের একজন করে তোলে। শুধু প্রতিভাই নয়, ক্লাব ও সমর্থকদের সঙ্গে তাঁর বন্ধন তাঁকে আরও স্পেশ্যাল করে তোলে। শুরু থেকেই সমর্থকেরা তাঁর পাশে ছিল, আর তার প্রতিদান তিনি দেন অনুগত্য ও আস্থার মাধ্যমে। সমর্থকদের কাছে মহেশ শুধু একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় নন, তিনি তাদেরই নিজেদের একজন।

মাঠে আগ্রাসনে প্রতীক তিনি। এই আগ্রাসনের জন্য একবার লাল কার্ডও দেখতে হয়েছিল তাঁকে, মহমেডান এসসি-র বিরুদ্ধে, গত বছর ৯ নভেম্বর। কিন্তু মাঠের বাইরে তিনি বাংলায় ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বলতে যা বোঝায়, একেবারে সেই রকমই। তবে মানসিক ভাবে তিনি কতটা কঠোর, তা তাঁর পরিশ্রমের কথা শুনলেই বোঝা যায়।
দলের ফল খারাপ হওয়া সত্ত্বেও মহেশ নিজেকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন সব সময়। কী ভাবে? “সত্যিই এটা কঠিন কাজ। বিশেষ করে দল যখন হারে। হারের পরের দিন কোনও সমর্থকের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। ঠিকমতো খেতে, ঘুমোতে পারি না। তবে ক্রমশ নিজেকে শান্ত করি। হারলে খারাপ লাগে ঠিকই। কিন্তু ভাবি, যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। এটা তো আর বদলানো যাবে না। তাই পরের ম্যাচে বরং সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, সে জন্য ঠিকমতো প্রস্তুতি নিই। তা হলেই বরং ভাল ফল পাওয়া যাবে এবং পরিস্থিতি বদলানো যাবে”, বলেন মহেশ। এ ভাবেই নিজেকে শক্ত রেখে দলকে সাহায্য করে যান তিনি। কিন্তু দল তাঁকে কবে তাঁর যোগ্য সন্মান ও সঙ্গী এনে দিতে পারবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: চার বছর পরে লর্ডসে ফের সেঞ্চুরি, ইতিহাস লিখলেন লোকেশ রাহুল
