সহজ-সরল এক কাহিনি জুড়ে বোনা দীপাবলির আমেজ। ‘গ্রেটার কালেশ’ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত।  

 


যার যেখানেই বছর কাটুক, উৎসবের দিনগুলোয় নিজের বাড়িটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। চেনা মানুষের ঘেরাটোপ, চেনা ঘরের ওম, চেনা হাতের রান্নার স্বাদ আর চেনা দুঃখ ভুলে চেনা সুখে ভাসা— বচ্ছরকার উৎসব মানে এইটুকুই তো চাওয়া। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস থাক, বাঙালি যেমন দুর্গাপুজোয় বাড়ি ফিরতে চায়, হিন্দি বলয়ের মানুষের কাছে দিওয়ালি মানেও ঠিক তেমনটাই। ঘরে ফেরার টান। দীপাবলির আমেজ মাখা দেশে ঠিক তেমনই এক ঘরে ফেরার গল্প বলতে হাজির নেটফ্লিক্সের নতুন ছবি ‘গ্রেটার কালেশ’।

 

 

ইদানীং ওটিটি-র কাহিনি মানেই রহস্যের জাল কিংবা সম্পর্কের জটপাকানো গল্প। সে ছবি হোক বা সিরিজ, মাল্টি লেয়ার প্লটে, লম্বা গল্পে তার পরতে পরতে ঠাসা নানা রকমের জটিলতা। পরের পর সেই পরত পেরিয়ে কোথাও বেরোবে অপরাধের সমাধান, কোথাও বা ছেঁড়াখোঁড়া সম্পর্কের ফাটল। ঠিক যেমনটা আজকাল বাস্তবেরও চেনা চেহারা। সে রিল হোক বা রিয়েল, এমন কঠিন অঙ্ক মেলানো জটিল, কুটিল দুনিয়ায় পর্দা যদি বলে এক সহজ-সরল এক পারিবারিক গল্প, তা মন ভরিয়ে দেয় বইকি! অহেতুক দীর্ঘ কাহিনির ভিড়ে ছোট্ট, মিষ্টি সেই কাহিনির ছত্রে ছত্রে বোনা নির্মল আনন্দ। আর ঠিক সেটাই বোধহয় ‘গ্রেটার কালেশ’-এর ইউএসপি। যে কাহিনি বলতে কোনও বড়সড় তারার ঝলমলানিতে ভর করেননি পরিচালক আদিত্য চান্দিওক বা কাহিনিকার ঋতু মাগো। বরং আস্থা রেখেছেন নিটোল গল্পের নিজস্ব নরম আলোয় আর ওটিটি পর্দার কয়েক জন চেনা মুখের অভিনয়ের উজ্জ্বলতায়। জটিল প্লট বুঝতে বুঝতে গল্পের খোসা ছাড়ানোর পরিশ্রমের একেবারে উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে যে গল্প খুব সহজে সেঁধিয়ে যেতে পারবে মনের ভিতর।   

 

 

অঙ্কে ভুল হয়নি মোটেই। ‘গ্রেটার কালেশ’-এর সবটুকু জুড়ে বুনে রাখা বাড়ির গল্পে, সম্পর্কের উষ্ণতায় সারাক্ষণ দীপাবলির আলোর মতোই ঝিকমিক করে উঠেছে চেনা দুঃখ, চেনা সুখ। যার পরতে পরতে খুব সহজে বলা, সহজে বোঝার ঝিলমিলে আনন্দ ঠাসা।

 


দিল্লির মেয়ে টুইঙ্কল হান্ডা (আহসাস চান্না) চাকরি করে বাড়ি থেকে ঢের দূরে বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু উৎসবের দিনে বাড়ি থেকে, বাবা-মা-ভাইয়ের থেকে এত দূরে বসে থাকতে কি আর মন চায়! বাড়ির মেয়ে তাই দীপাবলির আগেই বাড়ি ফেরে কাউকে না জানিয়ে, সকলকে চমকে দিতে। জানা ছিল না, উল্টে তারই জন্য অপেক্ষায় রয়েছে এক্কেবারে উল্টো রকম সারপ্রাইজ। টুইঙ্কল ফিরে থেকেই দেখে বাবা রঞ্জন (হ্যাপি রণজিৎ), মা সুনীতা (সুপ্রিয়া শুক্লা) বা ভাই অঙ্কুশ (পূজন ছাবরা) প্রত্যেকেই তার সঙ্গে কেমন অতিথির মতো ব্যবহার করছে, যেন কিছু গোপন করছে সযত্নে। জোরাজুরি করে শেষমেশ যা জানতে পারে, তাতে তার পায়ের তলার মাটি টলে যাওয়ার জোগাড়! আজন্মের যে বাড়ির টানে ফিরে আসা, যেখানে তার বড় হয়ে ওঠা, সে বাড়িটাই নাকি অন্য লোকের! শুধু তাই নয়, বাবাকে ছেড়ে তার মা চলে যেতে চায় বেঙ্গালুরু আর ভাইও নাকি দ্বিগুণ বয়সী এক নারীর প্রেমে হাবুডুবু! এত কিছু যে আপনজনেরা তার থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে, ভাবতেও পারেনি টুইঙ্কল। সে দুঃখ সে ভাগ করে নেয় বন্ধু পাঙ্খুরির (অক্ষয়া নায়েক) সঙ্গে। দু’জনে মিলে খুঁজে পায় আরও কিছু সত্যি। এসবের মধ্যেই এসে পড়ে দীপাবলির রাত। বাড়ির দিওয়ালি পার্টিতেও যে আরও কিছু চমক লুকিয়ে! সবকিছু পেরিয়ে কোন খাতে বইবে হান্ডা পরিবারের ভবিষ্যৎ? সে উত্তর ছবিতেই পাবেন। 

 


এঘরে ফেরা খুশিতে ডগমগ এক দিল্লিওয়ালি কন্যে থেকে আচমকা টালমাটাল হয়ে পড়া এক পরিবারের বিধ্বস্ত সদস্য— পুরো সফরটাতেই ভীষণ প্রাণবন্ত লাগে এহসাসকে। টুইঙ্কলের মা, বাবা, ভাইয়ের চরিত্রে সুপ্রিয়া, হ্যাপি কিংবা পূজন এক্কেবারে জীবন্ত। হ্যাপি-গো-লাকি পাঙ্খুরিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন অক্ষয়াও। গল্পের গুণে, প্রত্যেকের বলিষ্ঠ অভিনয়ে গোটা ছবিটাই পৌঁছে যায় এক অন্য উচ্চতায়। মন কাড়ে প্রত্যেকটা মুহূর্তে, প্রত্যেকটা ফ্রেমে ধরা এক সাধারণ পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়ার কোলাজে, ছত্রে ছত্রে বোনা নস্টালজিয়ার আমেজে। 
শেষপাতে একটাই মাত্র আফশোস থেকে যায় যদিও। এমন নিটোল গল্পের ক্লাইম্যাক্স সরলরেখায় হাঁটুক ক্ষতি নেই। তবে আরও খানিকটা নাটকীয় হলেও পারত!