আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিগ ফোর পরামর্শদাতা সংস্থাকে নিয়োগ করলে যে রকম পারফরম্যান্স আশা করা যায়, গত বছর একটি কল্যাণ সম্মতি ব্যবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য ডেলয়েটকে নিয়োগের পরে সেই আশাই করেছিল অস্ট্রেলিয়ান সরকার। পরিবর্তে সে দেশের সরকার ২৩৭ পৃষ্ঠার একটি এমন রিপোর্ট হাতে পায় যাতে যে সকল উৎস এবং বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, যার কোনও অস্তিত্বই নেই। এর পরে ডেলয়েট স্বীকার করে যে তাদের রিপোর্টের কিছু অংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) ব্যবহার করে লেখা হয়েছিল। পরামর্শদাতা সংস্থা জানিয়েছে, তারা তাদের কনসালটেন্সি ফি-র একটি অংশ অস্ট্রেলিয়া সরকারকে ফেরত দেবে। এর পরেই এআই ব্যবহার করে তৈরি পরামর্শের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
গল্পের শুরু কীভাবে?
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, অস্ট্রেলিয়ার কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্ক বিভাগ (DEWR) ডেলয়েটকে তার টার্গেটেড কমপ্লায়েন্স ফ্রেমওয়ার্কের একটি ‘স্বাধীন নিশ্চয়তা পর্যালোচনা’ পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যা কল্যাণমূলক বাধ্যবাধকতা মিস করা চাকরিপ্রার্থীদের শাস্তি দেয়। চুক্তিটির মূল্য ছিল প্রায় ৪৩৯,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার (২৯০,০০০ মার্কিন ডলার)।
ডেলয়েটের প্রতিবেদনটি ২০২৫ সালের জুলাই মাসে DEWR-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমে এটি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ ক্রিস রুজ অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন, প্রতিবেদনটিতে এমন শিক্ষাবিদ এবং আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছিল যাদের বাস্তব জীবনে কোনও অস্তিত্বই নেই। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে জানান, রিপোর্টে ফেডারেল আদালতের একজন বিচারকের নামে একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই কথা ওই বিচারক বলেননি। রিপোর্টে উদ্ধৃত বেশ কয়েকটি গবেষণা সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কিন্তু এমন কোনও গবেষণাপত্র পাওয়া যায়নি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্বীকার ডেলয়েটের
রিপোর্টটি খতিয়ে দেখে ডেলয়েট স্বীকার করে যে সেটিতে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। অবশেষে সেপ্টেম্বরে নির্ভুল রিপোর্ট পেশ করা হয়। সেটিতে লেখা হয়, Azure OpenAI GPT-4o ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর, ডেলয়েট তাদের পরামর্শ ফি-র চূড়ান্ত কিস্তি ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে।
এই ঘটনাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ
অস্ট্রেলিয়া সরকারের জন্য বিষয়টি তদারকি এবং নজরদারির খামতি বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, ডেলয়েটের অনুসন্ধান এবং সুপারিশগুলি এখনও বৈধ এবং কল্যাণ ব্যবস্থার মূল বিশ্লেষণ প্রভাবিত হয়নি। কিন্তু এই ঘটনাটি ডেলয়েটকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে বাধ্য করেছে যে জেনারেটিভ এআই একটি সরকারি প্রতিবেদন তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছে।
ডেলয়েটের জন্য বিষয়টি অস্বস্তিকর। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, সংস্থাটি এআই ফার্ম অ্যানথ্রপিকের সঙ্গে একটি চুক্তি ঘোষণা করেছিল যাতে তার প্রায় পাঁচ লক্ষ কর্মীকে ক্লড চ্যাটবট অ্যাক্সেস দেওয়া হয়। যা বিশ্বব্যাপী পরামর্শদাতাদের মধ্যে এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করে কাজ দ্রুত করার জন্য একটি বৃহত্তর পদক্ষেপের অংশ।

এআই হ্যালুসিনেশন কী?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবের পর থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হ্যালুসিনেশন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘এআই হ্যালুসিনেশন’ এমন ঘটনা বোঝায় যেখানে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম মিথ্যা তথ্য তৈরি করে। এই সিস্টেমগুলি বাস্তব বিশ্বের তথ্যের বিরুদ্ধে তথ্য যাচাই করে নয় বরং ভাষার ধরণের প্যাটার্ন আন্দাজ করে তথ্য তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি এআই চ্যাটবটকে রেফারেন্স, উদ্ধৃতি বা পরিসংখ্যান জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন এটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ উৎসগুলি ব্যবহার করে অনুপস্থিত বিবরণ তৈরি করতে পারে, যা বাস্তবে কাল্পনিক উৎস, নাম বা গবেষণা। অতএব, প্রযুক্তিগতভাবে এটি মিথ্যা নয়, এআই কেবল জানে না কোনটি বাস্তব এবং কোনটি নয়।
এই ধরনের হ্যালুসিনেশনগুলি প্রায়শই দীর্ঘ আকারের লেখা, গবেষণার সারাংশ বা উদ্ধৃতিতে দেখা যায়। প্রথম নজরে সেগুলিকে খাঁটি মনে হতে পারে কারণ সেগুলি সঠিক বিন্যাস এবং একাডেমিক তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এআই অস্তিত্বহীন প্রতিবেদনগুলিকে উল্লেখ করতে পারে, প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের ভুল উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারে বা এমন রায় তৈরি করতে পারে যা কখনও ঘটেনি, ঠিক যেমনটি ডেলয়েটের রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল।
ডেলয়েটের এই ভুল প্রথম নয়
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, ভারতের জাতীয় আর্থিক প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষ (এনএফআরএ) ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড (জিইইএল)-এর অডিটে ত্রুটির জন্য ডেলয়েট হাসকিন্স অ্যান্ড সেলস এলএলপি-কে দু’কোটি টাকা জরিমানা করে, পাশাপাশি দুই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে জরিমানা করে।
চীনে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন নিয়ন্ত্রকরা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে অডিটিং মান লঙ্ঘনের জন্য, বিশেষ করে ক্লায়েন্টদের নিজেদের অডিট করার অনুমতি দেওয়ার জন্য, ২০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছিল।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ডেলয়েটের কলম্বিয়ান সহযোগী, ডেলয়েট অ্যান্ড টাচ এসএএস-কে অডিট মান নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার জন্য পাবলিক কোম্পানি অ্যাকাউন্টিং ওভারসাইট বোর্ড (পিসিএওবি) কর্তৃক ৯০০,০০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছিল।
ডেলয়েট কানাডার ওন্টারিওতে নীতিগত এবং অডিটের নিয়ম লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করেছে, ২০২৪ সালে অডিট ওয়ার্কপেসের ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাকডেটিং’-এর জন্য ১.৫ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারেরও বেশি অর্থ প্রদান করেছে।
