গৌতম রায়
 
 সাম্প্রদায়িক শক্তির বিগত দশ বছরের দাপট যখন একটা অন্যমাত্রায় পরিচালিত হওয়ার সুযোগ খুঁজছে ভোট রাজনীতিতে নিজেদের কোনঠাসা হয়ে পড়বার দরুণ, এমন একটা অবস্থায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোনঠাসা করবার রণকৌশল তৈরির অন্যতম কারিগর সীতারাম ইয়েচুরি চলে গেলেন। প্রাণবন্ত এক রাজনীতিক। কনভেনশনাল রাজনীতিকদের মতো গোমরা মুখো নন এতটুকু। হাসি যেন লেগেই আছে মুখে। সেই হাসিটুকুর রেশ মুখের কোনে এঁকে রেখেই দাপুটে কমিউনিস্ট নেতা সীতারাম ইয়েচুরি চলে গেলেন।
 
 সীতারামের রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহে যেমন আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের মোকাবিলা পর্ব আছে, তেমনিই রয়েছে গোট দেশের ক্রমশঃ ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আবর্তে নিমজ্জিত হয়ে পড়বার কালপর্বও। সীতারাম তাঁর কলেজ জীবনে সাজতন্ত্রের জন্যে লড়াইয়ের মন্ত্রে তাঁর সংকল্পকে আরও দৃঢ়তায় উপস্থাপিত করতে ফেলেছিলেন আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করবার মধ্যে দিয়ে।
 
 সমাজতন্ত্রের জন্যে লড়াইকে, মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনের পরিকাঠামোকে বদলে দেওয়ার জন্যে সংগ্রামকে ভেস্তে দিতে রাষ্ট্র কী ভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে-সেই বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেহেতু সীতারাম তাঁর নিজের রাজনৈতিক পরিসরটিকে ব্যাপ্ত করতে শুরু করেছিলেন, তাই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজনীতির গতিপথকে তিনি কখনও বাস্তবতা বিমুখ হতে দেননি।
 
 রাজনীতিকে বাস্তবের সারিতে পুনঃস্থাপিত, প্রতিস্থাপিত করবার জন্যে যে লড়াই তাঁকে তাঁর দলের বাইরে অপেক্ষা দলের ভিতরে লড়তে হয়েছিল, তেমন লড়াই '৬৪ উত্তর সময়ে খুব বেশি কমিউনিষ্ট নেতাকে কখনও  লড়তে হয়নি। এইদিক থেকে বিচার করে বলতে হয় যে, ভারতে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ইতিহাসে ঘরে বাইরে লড়াইয়ের প্রশ্নে সীতারাম এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন।
 
 আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রাবস্থায় লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সেদিন জেএনইউ-এর ছাত্র সীতারাম ইয়েচুরি যে সাহস এবং বাস্তববোধের পরিচয় রেখেছিলেন, সেই সাহস আর বাস্তববোধের পরিপূর্ণ প্রকাশ ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে জীবনের শেষ পর্বে দীপ্ত ভাবে তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। কখনও একগুঁয়েমি এবং মতাদর্শের প্রশ্নে পুঁথিনির্ভর গোঁড়ামির শিকার হতে আমরা একবারের জন্যেও তাঁকে দেখিনি।
 
 মার্কসবাদ যে একটি বিজ্ঞান, সমাজবীক্ষার ফলিত অবস্থান অনুযায়ী সেই বিজ্ঞানের বাস্তবানুগ প্রয়োগটাই যে ফলিত বিজ্ঞানের প্রয়োগ জনিত অনুধ্যান--গোটা জীবন ধরে সীতারাম সে ভাবেই সমাজবিজ্ঞানকে দেখেছেন। ফলিত মার্কসবাদের প্রয়োগের প্রশ্নে হরকিষাণ সিং সুরজিত, জ্যোতি বসুর প্রজন্মের পরে সীতারাম ইয়েচুরি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে ভারতে তথা বিশ্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট্য হয়ে থাকবেন।
 
 সাম্প্রতিক অতীতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক মোকাবিলার প্রশ্নে 'আত্মা বনাম পরমাত্মা'-র উদাহরণ দিয়ে যে অসামান্য বক্তব্য সীতারাম রেখেছিলেন, তা থেকেই বুঝতে পারা যায়, পুঁথি সর্বস্বতার বেড়াজাল অতিক্রম করে , বৈচিত্র্যময় ভারত সংস্কৃতির কতটা গভীরে তাঁর মননলোকের শিকড় বিস্তৃত ছিল। একটা সময় সাধারণস্তরের একটা বড় অংশের  বামপন্থীদের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস ঘিরে একটা ভাবের ঘরে চুরি ছিল। ধর্ম বিশ্বাস অপেক্ষা কুসংস্কার, মাদুলি- তাবিজ কবচ নির্ভর বিষয়টিকেই ধর্ম বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতাও ছিল।
 
 এই উভয় অংশকে ঘিরেই আবার নেতৃত্বের একটা অংশের ভিতরে ছিল দারুণ পিউরিটান মানসিকতা। বস্তুত 'ধর্ম' আর 'ধর্মান্ধতা'-র মধ্যে যে সংঘাত , নাম্বুদ্রিপাদ-সুরজিৎ-বসু প্রজন্মের বায়োলজিকাল অনুপস্থিতির পর ভারতীয় সমাজব্যবস্থা এবং সমাজমনষ্কতার নিরিখে তার চর্চার ধারাটা কেমন যেন শুকিয়ে যেতে শুরু করেছিল।
 
 এই শুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কিন্তু আরএসএস-এও সংস্কৃতির প্রসারপথটাকে মসৃণ করতে শুরু করেছিল। সে ক্ষেত্রে সীতারাম ইয়েচুরির মতাদর্শগত অবস্থান এবং দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্ম আর ধর্মান্ধতার মধ্যে ফারাকটাকে পরিস্কর করে দেওয়া সহযোদ্ধাদের সামনে-এটা নিঃসন্দেহে বিগত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে গোটা দেশে অনেকখানি কোনঠাসা করে ফেলবার প্রশ্নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
 
 এনজিও রাজের বিরুদ্ধে নয়ের দশকে সীতারাম ইয়েচুরির যে থিসিস, সেখান থেকেই মনে হয়েছিল, সমাজবীক্ষণের নিরিখে ভবিষৎ রাজনীতির রূপরেখা দেখতে পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি হরকিষাণ সিং সুরজিতের সার্থক উত্তরসূরি। জাতীয় আন্দোলনের সশস্ত্র ভাবধারার মধ্যে দিয়ে কমিউনিষ্ট হয়েছিলেন সুরজিত। সেই ঘটনাবহুল জীবন সুরজিতকে যেন রাজনীতির বাস্তবতার এক দিব্য দৃষ্টি দিয়েছিল। একটু আবেগাপ্লুত হয়েই বলি, বাস্তব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বিশেষ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারা প্রকৃতির চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে দেখে, আগামী রাজনীতির গতিপথের একটা সংজ্ঞা নিরূপণ করার দিব্য দৃষ্টি যেন সীতারামকে দিয়ে গিয়েছিলেন সুরজিৎ।
 
 এনজিও ঘিরে নয়ের দশকে সীতারামের যে অবস্থান, তাকে যদি আন্তরিক ভাবে অনুসরণ করা সম্ভবপর হত, তবে রাজনীতির অঙ্গনকে প্রভাবিত করবার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থপুষ্ট এইসব গজিয়ে ওঠা সমাজসেবী এবং তাদের সংস্থাগুলি এত ক্ষমতাবান হতো না। বস্তুত এনজিও-রা বাংলাদেশে আটের দশকের গোড়া থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে শুরু করে এবং সমান্তরাল প্রশাসন আর অর্থনীতির ধারক বাহক হয়ে ওঠে, সেটা যে, যে কোনও মুহূর্তে ভারতীয় সমাজব্যবস্থাতেও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে-- সীতারামের সেদিনের সেই সতর্কবার্তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
 
 দুর্ভাগ্যের বিষয়, সীতারামের সেদিনের সতর্কবার্তার প্রতি বামপন্থীরা সেদিন যথোচিত সম্মান জানালেও, তাঁর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করবার ক্ষেত্রে আন্তরিক উদ্যোগ খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাতে তখন ধারাবাহিক ভাবে বামেরা ক্ষমতায় ছিল। পালাক্রমে কেরালেও তাঁরা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে সেদিন এমন কোনও ব্যবস্থা খুব দৃঢ় ভাবে অবলম্বনের ছায়া আমরা দেখিনি যেখানে এই এনজিও থেকে সামাজিক বিপদ এবং সেই বিপদ কিভাবে রাজনীতির উপরে পড়তে পারে, সে সম্পর্কে সীতারাম ইয়েচুরির যে সতর্কবার্তা-তার সুচারু ছাপ পড়েছে।
 
 সীতারাম ছিলেন আদ্যন্ত রাজনীতিক। সাম্রজ্যবাদের দ্বারা কোনও না কোন ও ভাবে প্রভাবিত, বিদেশি অনুদানে পুষ্ট এনজিওগুলি যে সাধারণ মানুষকে , বিশেষ করে গ্রাম- গঞ্জের একদম হা অন্ন মানুষকে অধিকর বোধ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, অধিকার সচেতন হতে দিচ্ছে না এটা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বার্থে, সেদিন যেভাবে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে সীতারাম দেখিয়েছিলেন, বাজার অর্থনীতির প্রসারের প্রথম পর্বে, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
 
 রাজনীতি যে কোন ও এঁদো পুকুর নয়। রাজনীতি হল এক বহতা নদী। অনেক সময়ে নদীর সেই স্রোত খরস্রোতাও-- এই বিশ্বাস নিয়েই রাজনীতিকে দেখতেন এবং সেই বিশ্বাস নিয়েই রাজনীতি করতেন সীতারাম। যে কংগ্রেসের আধা ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড জরুরি অবস্থার কালে, সীতারামকে সর্বক্ষণের রাজনীতিক করেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে ঠেকানোর প্রশ্নে , কেন্দ্র এবং দেশের প্রায় অধিকাংশ রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বাস্তবতা-- রাজনীতিকে সেই খরস্রোতা নদীর মতোই মর্যাদা দেওয়া-- এই প্রশ্নে সীতারামের যে বাস্তববোধ , তা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটা ভিন্নধারার তরিকা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
 
 বামপন্থী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে সীতারাম যদি আরও আগে উঠে আসতেন, তাহলে, ২০১৪ সালে, লোকসভা ভোটের সময়ে একক গরিষ্ঠতায় তো দূরের কথা, নীতিবিহীন- সুবিধাবাদী জোটের মাধ্যমে কেন্দ্রে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারত কি না সন্দেহের বিষয়। মতাদর্শে দৃঢ় থেকেও রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কখনও একগুঁয়ে, মৌলবাদী মানসিকতা সীতারাম দেখাননি। কালেক্টিভ লিডারশিপের প্রতি তাঁর যে যথার্থ সম্মান এবং মর্যাদা জানানোর মানসিকতা ছিল, সেটা ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমেই খুব দুর্লভ বস্তু হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
