উদ্দালক

যা ফেলে আসি, তাই কি কাঁদায়? সব আছে, তবু যেন কিছু একটা নেই-নেই ভাব! স্মৃতি জড়ো করে নিয়ে বসে আছি আমরা। থইথই করছে অন্তর। উপচে পড়ছে কখনও। তবু সামলে চলতে হয় প্রতি মুহূর্তে। আদত মানুষটাকে বোঝাতে হয়, বারবার বিড়বিড় করতে হয়, 'ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি...' ইত্যাদি। কিন্তু হঠাৎ কোনও শরতের সকালে পায়ে যখন এসে লাগে শিশির। শীতের রাতে অন্ধকারে শোনা যায় রাতচরা পাখির গলা-চেরা ডাক বা বৃষ্টির দুপুরে অবসরকে ছুঁয়ে দেয় কয়েক আঁজলা জল, তখন আর অন্তর মানে না নিষেধ। উপচে পড়ে তাঁর সমস্ত বাঁধুনি ছাড়িয়ে। তেমনই তথাগত মুখার্জি পরিচালিত 'রাস' ছবিটি ধীরে ধীরে দর্শকের ইন্দ্রিয় পেরিয়ে হৃদয় হয়ে মস্তিস্কে প্রবেশ করে, নাড়িয়ে দেয়। শেষ মুহূর্তে তার ম্যাজিকে উপচে পড়ে আবেগ। 


বাংলা ছবির জন্য এই মাসটি সুফলা। তিন-চারটি অন্যধারার ছবি নিয়ে দর্শকমহল সরগরম। বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পগুণেও সিনেমাগুলো অন্যরকম প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে। 'রাস' সেই তালিকায় অন্যতম। গল্প এক আমাদের অনেকের মতোই শহরবাসী এক যুবকের। চাকরি করে সে। দশটা-পাঁচটার কঠিন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা তার জীবন। কিন্তু সে চায় না এমন। কে-ই বা চায়। শৈশবের স্মৃতি, শহরের গলা-টিপে ধরা জীবনের মাঝে উঁকি মারে। উঁকি মারে উপড়ে যাওয়া নাড়ির টান। সেই টানে সে ফিরে যায় ফেলে আসা গ্রামের বাড়িতে, ঠাকুমার সংসারে। তারপরেই শুরু হয় ম্যাজিক। 


পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায় এই ছবির গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। সেই কারণে ছবির সমালোচনায় গল্পটি আবার করে লেখা উচিত নয়। বরং আলোচনা করা উচিত ছবির মূল আধার গল্পটি নিয়ে। গল্প থেকে চিত্রনাট্য হয়ে সংলাপে পৌঁছানোর যাত্রায় তথাগত অনবদ্য। ছবির সংলাপের পরতে-পরতে যেন কবিতার মায়া ছড়ানো আছে। ইমতিয়াজ আলি পরিচালিত 'তামাশা'-ছবিতে আমরা দেখেছিলাম দ্বিসত্ত্বার লড়াইয়ে পিষে যাওয়া এক যুবকের প্রেম-বিরহ ও প্যাশন নিয়ে বেঁচে থাকার এক আপ্রাণ লড়াইয়ের গল্প। চমকে দিয়েছিলেন ইমতিয়াজ। তথাগতকে লড়তে হয়েছে এমনই অতি-সাধারণ এক লড়াইকে অসাধারণ করার যুদ্ধে। সেখানে ইমতিয়াজের মতো পরিচালকরা কাজ করে গিয়েছেন। সেই লড়াইয়ে তথাগত শুধু সফল নন, চ্যাম্পিয়ন। পরিচালনা-সহ প্রতিটি বিভাগে তাঁর অন্তর চেরা দরদ চোখে পড়েছে। 


ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছেন বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, অনসূয়া মজুমদাররা। এমনকী প্রতিটি পার্শ্বচরিত্রেরও কী অসাধারণ সব স্তর! শঙ্কর দেবনাথ, অনির্বাণ চক্রবর্তী, অর্ণ মুখার্জিদের দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড ঝগড়ার পর দাদার হাত ধরে খাটে বসে অতীতের কথা বলতে বলতে যখন অনির্বাণের চোখে জল আসে বা ডান পাশে মুখ ঘুরিয়ে একগাল দাড়ি ভরা মুখে শঙ্করের ছলছলে শোনা যায় বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে পুলিশের মেরে দেওয়ার কথা, তখন একটা বিস্তৃত প্রজন্ম তাদের চোখের সামনে বাবা-কাকা বা বড়দা-দের আপোষহীন, চোয়ালশক্ত মুখগুলোকে এক লহমায় দেখতে পান। বড়লোক নয়, তাঁরা ছিলেন বড় মানুষ, ভাবতে-ভাবতে কঁকিয়ে ওঠে ভিতরটা! প্রশ্ন তোলপাড় করে, আমরা কি সুবিধাবাদী! বা ঠাকুমার কাছে সারভাইবাল নিয়ে কথা বলতে বলতে যখন কেঁদে ফেলে নায়ক সোমনাথ আর ঠাকুমা বলেন, সারভাইব করব কেন, বাঁচব, যতদিন প্রাণ আছে বাঁচব। কথাগুলো শুনে প্রিয়জনের বুকে মাথা গুঁজে যাদের কেঁদে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করে, তথাগত বোধহয় তাঁদের জন্যই এই ছবি তৈরি করে রাখলেন। 


ছবিতে অনবদ্য কাজ করেছেন সঙ্গীত ও আবহ পরিচালক সাত্যকী ব্যানার্জি। তিনি লোকসঙ্গীতের স্তম্ভ সমান প্রতিভা ও গবেষক। তাঁর হাতে যেভাবে ছবির দৃশ্যে ফিরে ফিরে এসেছে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার, তা আশ্চর্য উচ্চতায় নিয়ে যায় আমাদের। বাংলার লতায়-পাতায় জড়িয়ে আছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা। সমস্ত সম্পর্কে কাঠামোকেই সেই আধারে স্থাপন করা চলে। কখনও কখনও সেই গাথার সঙ্গীতের ভাষ্কর্য হঠাৎ রামধনু তৈরি করে আকাশে। তেমনই দেহাতি প্রেমলীলার সঙ্গীত বা মাতনের হরিবোল ধ্বনি মিশে যায় রাস উৎসবের আয়োজনের মাঝে লুটিয়ে থাকা সম্পর্কের কোনও উত্তপ্ত মুহূর্তে। তাল ফেরতার ঝোড়ো বাতাস হুহু করে বৈশাখী ঝড়ের মতো টালমাটাল করে তোলে সুপ্ত আবেগককে। সাত্যকি, সেলাম!


সব মিলিয়ে ছবির নির্দিষ্ট গতিপথ, বহুমুখি গল্প বলার ভাবনা, প্রতিটি চরিত্রকে যত্নে গড়ে তোলার স্নেহ, ছবিকে অঘ্রাণের সোনালি ধানের মতো সতেজ করেছে। সেই কারণেই আমাদের খোঁজা মিলে গিয়েছে পর্দায়। আর মিলবে নাই বা কেন, এ যে ফেলে আসার দিকে চোখ তুলে তাকানো। যে মামা গত হয়েছে গত বর্ষায়, যে দিদার টাকা জমানোর কৌটটা আছে, কিন্তু মানুষটা নেই, যে ফুলপিসি আচারের বয়াম রেখেই চলে গিয়েছে চিরকালের মতো, যে সাইকেলে আর কখনও টান দেবেন না নকশাল সন্দেহে পুলিশের গুলি খাওয়া ছোটকাকা, তথাগতর ছবিটি থাকবে তাঁদের জন্য। থাক নাদীর্ঘশ্বাসও তো থাকে, তেমনই না-পাওয়ার রঙে রাঙা হয়ে থাক রাস।