আজকাল ওয়েবডেস্ক: ক'দিন থেকে 'টফি' সহজে কিছু মুখে তুলতে চাইছে না। তার মা খুব উদ্বিগ্ন। এমনিতে টফি সর্বভুক। একটু আমিষ ভালবাসে। তা বলে চিকেনের বদলে আলু,গাজর দিয়েও খাওয়া সেরে নেয়। কিন্তু কদিন ধরে তার খাওয়ায় রুচি নেই। খেতে গিয়েও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাজির শব্দে চমকে ওঠার পর থেকেই তা বেশি হচ্ছে।
 
 টফি একটি শান্ত স্পিটজ কুকুর। এরা খুব চেঁচায়, কিন্তু খুব আদুরে। তাই একসময় ঘরে এদেরই বেশি পোষা হয়। টফির পালক মা বিভিন্ন 'পেট শপ'-এ ফোন করলেন। ফোন করে জানলেন,উদ্বেগ কমাবার কিছু ওষুধ আছে বৈকি।  কয়েকদিন ধরে সেই ওষুধ লাগাতার বিক্রি হয়ে চলেছে। 
 
 বর্ধমানের পরিচিত ব্যবসায়ী ও পশুপ্রেমী শান্তনু পাঁজা জানাচ্ছেন, 'যে আয়ুর্বেদিক ওষুধটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত,  তা সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে পাইনি। পরে অনলাইনে তা আনাতে হয়েছে আমাকে।'
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
পুজো থেকে দীপাবলি হয়ে ছট পুজো। কিন্তু শব্দবাজির ভূত পিছু ছাড়ছে না মফঃস্বল এলাকাতেও। এই আওয়াজে প্রবীণ, অসুস্থ মানুষদের যেমন কষ্ট হয় ঠিক তেমনি চরমভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহপালিত কুকুর,বিড়ালরাও। রাস্তার কুকুর বা বিড়ালরা তো আরো অসহায়। তাদের গায়ে পটকা ফাটিয়ে,লেজে বাজি বেঁধে বিকৃত আনন্দ পায় কিছু মানুষ। বাড়ির কুকুররাও চরম অসহায়। গত কয়েকবছর ধরে বর্ধমানেও কলকাতার মতো কুকুর বা বিড়াল পোষার প্রবণতা বাড়ছে।শহরে এখন গোটা পঞ্চাশেক পেট শপ। বেশ কিছু ভেটেরিনারি ক্লিনিক, হাসপাতাল। সরকারি পরিষেবার পাশাপাশি এর সংখ্যা বৃদ্ধি বুঝিয়ে দেয় এই কথা না বলা বন্ধুদের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বেড়েছে। বেশ কয়েকটি পশুপ্রেমী সংস্থাও পথ কুকুরদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
 
 করোনার সময় মানুষ যখন একলা হয়ে পড়েন, তখন পোষ্য নির্ভরতা আরও বেড়ে যায় শহর বর্ধমানে। পশুপাখিদের নিয়ে  ধারাবাহিক কাজ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক  ডা: পার্থ সরকার। তিনি জানাচ্ছেন,পোষ্য রাখার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। বর্ধমান ও লাগোয়া এলাকায় পোষ্যের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার। এর মধ্যে কুকুর,বিড়াল সবই আছে। একটি পরিসংখ্যানের সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি পোষ্য কুকুর বিড়ালের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হতে পারে।
 
 সকালে যে কোনোওদিন তেঁতুলতলা, নীলপুর,  পুলিশ লাইন বা রথতলা  বাজারে গেলে বোঝা যায়, কত মানুষ কুকুর বা বিড়ালের জন্য মাছ,মাংস কিনতে আসছেন। গত কয়েকদিন ধরে শব্দবাজির দাপট ক্রমশ বাড়ছে। সারা বছর নানা অনুষ্ঠানে, ধর্মের নামে শব্দের অত্যাচার বাড়ে। তবে এ বছর পুজোর সময় শব্দের দাপট অনেকটাই কম ছিল। 
সেটা পুষিয়ে দিয়েছে দীপাবলী। কালীপুজোর রাত থেকে কানফাটানো শব্দে শহরের নানা প্রান্তে বাজি,পটকা ফেটেই চলেছে। ছট পুজো অবধি এই অত্যাচার চললে, কী হবে ভাবতে ভয় পাচ্ছেন পশুপ্রেমীরা। গত কয়েকদিনে চিত্রটা উদ্বেগজনক রূপ পেয়েছে। বর্ধমানের ঘোড়দোড়চটি বা মুচিপাড়ার দুটি বেসরকারি হাসপাতালে কয়েকশো অবলা রোগী এসেছে। এদের মধ্যে কুকুর বেশি, বিড়াল কম। সব প্রজাতিই আছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা: জাহাঙ্গীর খান এই অবলাদের বিপন্নতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন,মানসিক চাপ ও ভয় চেপে বসে। বোমার বিকট শব্দে কুকুরদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর ফলে তারা খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে বা খুব বেশি কুঁকড়ে থাকতে পারে।
আরও পড়ুন: বড় লাফ দেওয়ার আগে থামল না তো! সোনা এবং রুপোর দামের পতন দেখে প্রমাদ গুনছেন বিশেষজ্ঞরা
 
 শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত উচ্চ শব্দে তাদের শ্রবণশক্তি চিরস্থায়ীভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেইসঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকিও আছে।  তীব্র শব্দের কারণে কুকুরদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে, শব্দের তীব্রতা এত বেশি হয় যে কুকুররা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। ভয়ের কারণে তারা দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করতে পারে, যা তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। অতিরিক্ত  শব্দের কারণে তারা নিজেদের পরিচিত এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায় এবং সেখানে অন্য কুকুরদের সাথে তাদের ঝগড়াও হতে পারে। উল্লেখ্য, কালীপুজোর রাতে কলকাতায় একটি কুকুর শব্দবাজির আওয়াজে ভীত হয়ে মেট্রো রেলের প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ট্রেনে উঠে পড়ে। ওই পশু চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী,  এর ফলে পোষ্যদের দেহের উষ্ণতা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও  অতিরিক্ত আওয়াজে কুকুরদের রক্তচাপও বেড়ে যায়।
কুকুরের মতো সংখ্যায় কম হলেও খরগোশ এবং পাখিও এতে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে একটি পেট হাসপাতালের কর্ণধার বৈশাখী চক্রবর্তী জানান, 'বিভিন্ন প্রজাতির কুকুররা এতে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। মাথা গুঁজে পড়ে থাকছে। হাসপাতালে নিয়ে আসতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে এই সময় কুকুর যারা পোষেন তাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। ভয় কাটাতে সঙ্গ দিতে হবে। প্রাণী প্রশিক্ষক ও পশুপ্রেমী অর্ণব দাস দীর্ঘদিন বিভিন্ন পশুপাখি নিয়ে কাজ করে আসছেন। তিনি জানান, কুকুর খুব সংবেদনশীল প্রাণী। শব্দের কম্পাঙ্ক সহ্যসীমার বাইরে হলে এরা অস্থির হয়ে পড়ে। খাওয়া বন্ধ করে। মালিক বা প্রিয়জনকে খোঁজে। আড়াল বা খাঁটের নিচে চলে যেতে চায়। তীব্রতা বেশি হলে হৃদজনিত সমস্যা হতে পারে। তাঁর পর্যবেক্ষণ, বড় এবং শক্তিশালী কুকুররাও রীতিমতো আতঙ্কিত হয় বাজির শব্দে। তাঁর মতে, এই সময়ে ভীত পোষ্যটিকে যথেষ্ট সঙ্গ দিতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। এর পাশাপাশি তাঁর পর্যবেক্ষণ, দীপাবলীর অতিরিক্ত আলো পরিযায়ী পাখিদের পর্যন্ত বিপদে ফেলছে। তারা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব অতিক্রম করে। কিন্তু রাতের আলো ঝলমলে আকাশে তারা বিভ্রান্ত হয়। উড়ে যায় ক্ষমতার বেশি। এর ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। বেশ কিছু পাখিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বনাথ রায় জানান, শব্দবাজির ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তাঁরা চান, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এগিয়ে আসুক।
 
 ঘরে যারা পোষ্য রাখেন,  তাদের একজন সমাজকর্মী সমাপ্তিকা মন্ডল। তাঁর মতে, আনন্দ পালনের অনেক উপায় আছে। প্রচুর শব্দহীন আতসবাজি আছে, আলো আছে। শব্দ দানবের আশ্রয় যারা নেন, তারাও এক ধরণের দানব।
 
 অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও ভূ-পর্যটক  শান্তনু পাঁজার বাড়ি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ  হাসপাতালের পাশেই।  তিনি জানাচ্ছেন, শব্দবাজি মানুষের মতোই একইভাবে প্রাণীদের কষ্ট ডেকে আনে।
 
 তার প্রশ্ন, আর কবে সচেতন হব আমরা? 
ডা: পার্থ সরকার এবং অর্ণব দাস আরও জানিয়েছেন, এইসময় 'পেট পেরেন্ট'দেরও সংবেদনশীল হতে হবে। ফোর্স ফিডিং বা জোর করে খাওয়ানো উচিত নয়। এদের একটি আরামদায়ক,নিরাপদ,পরিবেশে রাখতে হবে। অসুবিধা বুঝলে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কোনো সুন্দর আওয়াজের সঙ্গীত চালানো যেতে পারে যাতে স্ট্রেস সহনীয় হয়।
