কৃশানু মজুমদার: তিনি ছিলেন ফুটবলার। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হল, তিনি পুরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ হয়ে গিয়েছেন। তিনি মেহমুদ খাবাজি।

 মহমেডান স্পোর্টিং-ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরে কলকাতা ময়দানে ফুল ফুটিয়েছিলেন একসময়ে। মজিদ বিসকর, জামশিদ নাসিরির দাদাস্থানীয় এই খাবাজি। কয়েকযুগ তিনি দেশে ফেরেন না। সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তাঁর সঙ্গে যখন যোগাযোগ করা হল তিনি তখন প্যারিসে।

আজকাল ডট ইন-কে খাবাজি বললেন, ''সুইডেন সরকার আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। প্রায় ৪৮ বছর হয়ে গেল আমি ইরান ছাড়া। আমার পরিবারের কোনও সদস্যই আর ইরানে নেই। অনেকে কানাডায় চলে গিয়েছে। আমি এখন প্যারিসে আছি। দেশের পরিস্থিতি দেখে আমি আতঙ্কিত।'' 

খাবাজি, জামশিদ ও মজিদ--এই ইরানি ত্রয়ীর মধ্যে কলকাতার হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন একজনই। তিনি মজিদ। কেউ তাঁকে 'বোহেমিয়ান বাদশা' বলে ডাকতেন। কেউ আবার তাঁকে ময়দানের 'দেবদাস' বলতেন। 

Emotional homecoming for East Bengal's legendary striker Majid Beshkar -  Sportstar

ইস্টবেঙ্গলের আমন্ত্রণে কয়েকবছর আগে কলকাতায় পা রেখেছিলেন মজিদ। সেই সময়ে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে বসে তিনি বলেছিলেন, ''ইস্টবেঙ্গলে জামশিদ ৯ নম্বর জার্সি নিল। আমি নিলাম ১২ নম্বর জার্সি। ১২ আর ৯ যোগ করলে কত হয়? ২১ তাই না? খাবাজি তখন আমার আর জামশিদের জার্সির নম্বর যোগ করে ২১ নম্বর নিল।'' সেই ভ্রাতৃসম মজিদের সঙ্গে এখন কদাচিৎ কথা হয় খাবাজির। কমে এসেছে যোগাযোগ। 

ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরার আগে রেড রোডের ধারের মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছিলেন খাবাজি। সাদা-কালো ব্রিগেডের তিনিই প্রথম ইরানি ফুটবলার। খাবাজির হাত ধরেই সাদা-কালো শিবিরে এসেছিলেন আর এক ইরানীয় ফুটবলার। তিনি আহমেদ সানজারি। 

ইজরায়েল-ইরান সংঘাতের আবহে কেমন আছেন আহমেদ সানজারি-মজিদ বিসকর? এই প্রতিবেদক দুই প্রাক্তন ফুটবলারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। মজিদ হোয়াটসঅ্যাপে ছোট বার্তা পাঠান, ''দুই তরফেই শুরু হয়েছে বোমা বর্ষণ।'' তার পর একাধিকবার মজিদকে ফোনে ধরার চেষ্টা করা হলেও ইরানিয়ান ম্যাজিশিয়ান ফোন ধরেননি।

খাবাজির কাছে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপ্পন করা হলে তিনি বলেন, ''সানজারি বা মজিদ কেউ আপনাকে এই যুদ্ধ নিয়ে একটা কথাও বলবে না। কারণ ওদের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এবং তা যদি ইরানের সরকার জানতে পারে, তাহলে ওদের জেলে ঢুকিয়ে দেবে। আমিও খুব বেশি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করি না। তাহলে ওরা সমস্যায় পড়তে পারে। কিন্তু ওদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা।''

খাবাজির সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল, তিনি কি নিছকই একজন ফুটবলার! নাকি তারও বেশি কিছু! দেশে না থাকলেও ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর নখদর্পণে। ইরান সরকারের নিন্দা করে তিনি বলছিলেন, ''এই পরিস্থিতির জন্য ইরানের সরকারই দায়ি। ইরানের স্থানীয় মানুষের আস্থা-সমর্থন সব হারিয়েছে এই সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে এই সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে ইজরায়েল।'' 

কথা বলতে বলতেই খাবাজি ফিরে দেখছেন তাঁর কলকাতায় খেলে যাওয়া পর্ব। পিছনের দিকে তাকিয়ে বলছেন, ''কলকাতায় খেলার সময়ে ইরানের দূতাবাস থেকে আমাদের উপরে চাপ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা খোমেইনির পোস্টার হাতে নিয়ে আমরা যেন তাঁর হয়ে স্লোগান দিই। আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, খেলতে এসেছি ভারতে। রাজনৈতিক বিষয়ে আমরা জড়াতে চাই না। বিশ্বাস করবেন না কলকাতায় আমাদের রিফিউজির মতো দিন কাটাতে হয়েছিল।'' 

তিনি এখন সিমেন্টের ব্যবসা করেন। এই দেশের বিভিন্ন অংশ তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। ভুলতে পারেননি কলকাতাকে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। বলেন, ''আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নিশ্চয়ই আমার কথাও লেখা রয়েছে।''

অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসেন দ্রুত। বলেন, ''ইরানের সরকার সব দিক থেকেই বিশ্বাস ভেঙেছে। দেশের ভিতরে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করে রেখেছে প্রচুর। অথচ বহির্বিশ্বের কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। আজকের এই পরিস্থিতি খুব সহজেই এড়ানো যেত। কিন্তু সরকারের ভুলেই যুদ্ধের গনগনে তেজ এখন অনুভব করছে দেশ। নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন।'' 

তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন শান্তি ফিরবে দেশে। নতুন কোনও ভোরের খোঁজে কলকাতায় খেলে যাওয়া প্রাক্তন তারকা মেহমুদ খাবাজি। কিন্তু সেই ভোর কবে আসবে কেউ জানেন না। ইরানের সকালগুলো এখন যে রাতের চেয়েও অন্ধকার!