অসম বন্ধুত্বের কাহিনিতে কতটা চোখ টানলেন জুনিয়র বচ্চন? ‘কালীধর লাপতা’ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত। 


নিজের জন্য মনের আনন্দে বাঁচা ঠিক কতটা জরুরি? ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছেগুলো পূরণ হলে ঠিক কেমন লাগে? চারপাশের এই অবিরাম ছুটতে থাকা দুনিয়ায় যখন স্বার্থের অঙ্ক কষেই খোলা হয় সম্পর্কের খাতা, তখন কি স্রেফ ভালবাসার বাঁধনে ধরা দেওয়া যায় এক অসমবয়সী বন্ধুত্বে? সোশ্যাল মিডিয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া, জটিল-কুটিল মনস্তত্ত্বে ঠাসা এক পৃথিবীতে এক সহজ সরল নিটোল গল্পই জুগিয়ে দিয়ে গেল সেই সব উত্তর। জি ফাইভের নতুন ছবি ‘কালীধর লাপতা’ তাই মন ছুঁয়ে যেতে সময় নিল না মোটেই। মধ্যবয়সী কালীধর আর বছর দশের বল্লুর নিখাদ বন্ধুত্ব পর্দা জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে গেল মুঠোভর্তি উষ্ণতা। মাথার ভিতর, মনের মধ্যে যার রেশ রয়ে গেল বহু বহুক্ষণ। 

 


বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা কালীধর (অভিষেক বচ্চন) বাবার মৃত্যুর পর তিন ভাইবোনকে বড় করেছিল অতি কষ্টে। নিজের পড়াশোনা হয়নি, এমনকি বিয়ে করা হয়নি প্রেমিকাকেও। তার বদলে সে নিজের পায়ে দাঁড় করায় ভাইবোনেদের। তাদের বিয়েও দেয়। তৈরি করে নিজেদের পাকা বাড়ি। এহেন কালীধর মধ্যবয়সে এসে স্মৃতি লোপের সমস্যায় আক্রান্ত হলে ভাইয়েরা কিন্তু তাকে আগলে রাখতে চায়নি। ধার-দেনা করে ‘বড়লোকের অসুখ’-এর চিকিৎসা করানোর চেয়ে সম্পত্তির ভোগদখলই তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। হাসপাতালে ঘুমন্ত কালীধরকে দিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তরের কাগজে সই করিয়ে নিলেও তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা বানচাল হয়ে যায় শেষমেশ। অগত্যা দুই ভাই এবং বাড়ির বৌ মিলে ষড়যন্ত্র করে তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে কুম্ভের মেলায়। উদ্দেশ্য, কালীধরের স্মৃতিভ্রমের সুযোগ নিয়ে তাকে সেখানেই রেখে আসা। ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়া ভাইদের খুঁজতে খুঁজতে কালীধরও সে প্ল্যানের হদিশও পেয়ে যায়। বিধ্বস্ত দাদা ঠিক করে সে নিজেই বরং হারিয়ে যাবে এবার। যেমন কথা, তেমনি কাজ, বাসে চেপে দিকশূন্যপুরের দিকে রওনা দেয় কালীধর। পয়সার অভাবে নেমে পড়তে হয় মধ্যপ্রদেশের এক অচেনা গ্রামে। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা দশ বছরের ছেলে বল্লুর (দৈবিক বাঘেলা)। 

 

আরও পড়ুন: মা হতে চলেছেন পরিণীতি চোপড়া? প্রথমবার ‘সুখবর’ দিলেন অভিনেত্রীর স্বামী রাঘব চাড্ডা!


অনাথ বল্লুই ধস্ত, হতাশায় ডুবে থাকা কালীধরকে আবার ফিরিয়ে দেয় জীবনের দিকে। জাগিয়ে তোলে মনের আনন্দে, ছোট্ট ছোট্ট খুশি আঁকড়ে পথচলার ইচ্ছে। ছোট্ট বল্লুর সঙ্গে এই অসমবয়সী বন্ধুত্বের ওম, তাকে আগলে রাখার সুখ কালীধরকে ফের বাঁচতে শেখায়। বিরিয়ানি খাওয়া থেকে বাইকে চাপা, বিয়েবাড়িতে নাচাগানা থেকে কালীধরের হারানো প্রেমিকা মীরার (নিমরত কউর) খোঁজ— দু’জনে মিলে বাকেট লিস্ট মেলাতে মেলাতেই জুড়ে যায় এক অটুট বন্ধনে।      

এদিকে কালীধরের ভাইয়েরা খুশিমনে বাড়ি ফিরলেও ইতিমধ্যে আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছে আইনি নথি। দাদা বাড়ি না ফিরলে তবে যে বাড়ির দখলও পাওয়া যাবে না! অগত্যা ভাইয়েরা ফের হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে কালীধরকে। তাদের হয়ে সে ভার নেয় প্রয়াগের পুলিশ ইনস্পেক্টর সুবোধ (মহম্মদ জিশান আয়ুব)। কালীধরকে কি খুঁজে পাবে তারা? ইচ্ছেপূরণ হবে ভাইদের? কালীধর-বল্লুর বন্ধুত্বই বা কোন পথে গড়াবে?  সে সব জানতে হলে অবশ্য ছবিটা দেখতে হবে।

 


নিজেরই তামিল ছবি অবলম্বনে হিন্দিতে ‘কালীধর লাপতা’ তৈরি করেছেন পরিচালক মধুমিতা। দক্ষিণী সংস্করণের শহুরে স্বাদের বদলে এ ছবি জুড়ে, তার গানগুলোয় মেঠো গন্ধ, মাটির সুবাস আর ভরপুর প্রাণবন্ততা। তারই মধ্যে ঝলমল করে বল্লু-কালীধরের একটু একটু করে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, তাদের নির্মল বন্ধুত্বের সহজ সারল্য। যার সবটুকু মনপ্রাণ ঢেলে জীবন্ত করে তুলেছেন অভিষেক বচ্চন। নতুন করে বুঝিয়েছেন পাপা বচ্চনের ছায়া থেকে বাইরে বেরোতে দিলে বলিউড তাঁর কাছে আরও অনেক কিছু পেতে পারত। এমন এক বলিষ্ঠ অভিনেতার বিপরীতে দাঁড়িয়েও সমানতালে নজর কেড়ে গিয়েছে ছোট্ট দৈবিক। কমেডি টাইমিংয়ে, নিষ্পাপ চোখের ভাষায়, নির্মল হাসিতে ভারী মন ভাল করা তার অভিনয়। ছোট্ট উপস্থিতিতে যথারীতি মন কাড়েন নিমরত। সংক্ষিপ্ত পরিসরেও মনে দাগ কেটে যান সুবোধ-রূপী জিশানও।

 


তবে হ্যাঁ, দশ বছরের ছেলের মুখে জীবনদর্শনের একের পর এক সংলাপ খানিকটা ভারী হয়ে গিয়েছে, পরের দিকে একটু যেন একঘেয়েও। তাছাড়া, ছবি জুড়ে বল্লুর হাত ধরে কালীধরের দিন বয়ে চলে সরলরেখায়। বিপদ এলেও দাগ কাটেনি সেভাবে। একটু আধটু ক্রাইসিস থাকলে, সেগুলো থেকে বাঁচতে খানিক লড়াই করতে হলে জীবনটাও বোধহয় আরেকটু বাড়তি মানে পায়। এইটুকুই যা রয়ে গেল ভুলের খাতায়। বাকি সবটাই বড্ড মন ছোঁয়া, ভারী মিঠে আর সহজ। যন্ত্রের মতো চলতে থাকা রুটিনে, ওটিটি জুড়ে জটিল বুনোটের গল্পের ভিড়ে সেটাই যে বিরাট প্রাপ্তি!