আজকাল ওয়েবডেস্ক: ব্রিটেনে উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে শনিবার ১৩ সেপ্টেম্বর টমি রবিনসনের নেতৃত্বে আয়োজিত বিশাল সমাবেশ রীতিমতো অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ‘ইউনাইট দ্য কিংডম’ নামের এই মিছিলে মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এক লক্ষেরও বেশি মানুষ অংশ নেন। রবিনসন—যাঁর আসল নাম স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন—দাবি করেন যে এই সমাবেশ মূলত ‘মুক্ত বক্তব্য রক্ষার জন্য’।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুলিশ জানিয়েছে, রবিনসনের সমর্থকদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বোতল, ঘুষি, লাথি—সবই ছোঁড়া হয় পুলিশের দিকে। আহত হন একাধিক পুলিশকর্মী। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত দাঙ্গা-নিয়ন্ত্রণ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আরও অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন স্ট্যান্ড আপ টু রেসিজম প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে নিয়ে পাল্টা মিছিল করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘মার্চ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম’। সেখানে স্লোগান ওঠে—“শরণার্থীরা স্বাগত”, “ডানপন্থার মোকাবিলা করো”, “ফাইট ব্যাক”। রবিনসনের সমাবেশে স্পষ্টতই অভিবাসী বিরোধী বক্তব্যই প্রাধান্য পায়। স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক জম্মুরের মতো ফরাসি চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদ সরাসরি বলেন, “আমাদের জনগণকে দক্ষিণ দিক (Global south) থেকে আসা মুসলিম সংস্কৃতির মানুষেরা প্রতিস্থাপন করছে। আমরা নিজেদের উপনিবেশকারীদের দ্বারাই আজ পরাধীন হচ্ছি।”
আরও পড়ুন: 'বিপ্লবের' পর নেপালে যৌনতা শুরু করার দাবি মানবাধিকার কর্মীদের!
আরও বিস্ময়করভাবে, এক ভিডিও বার্তায় এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কও সমর্থন জানান রবিনসনদের বক্তব্যে। তিনি অভিযোগ করেন, “অসংযত অভিবাসন ব্রিটেনকে ধ্বংস করছে। ধীরে ধীরে হলেও এর গতি ক্রমশ বাড়ছে।” সমাবেশে শোনা যায় স্লোগান—“উই ওয়ান্ট আওয়ার কান্ট্রি ব্যাক”, “স্টপ দ্য বোটস”, “সেন্ড দেম হোম”, “সেভ আওয়ার চিলড্রেন”। লাল-সাদা সেন্ট জর্জ ক্রস এবং ইউনিয়ন জ্যাক পতাকায় ভরে যায় রাস্তা। উপস্থিত জনতা ব্যাগপাইপে বাজিয়ে মার্কিন উগ্র ডানপন্থী কর্মী চার্লি কার্কের স্মরণে নীরবতা পালন করে।
বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ঘিরে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ পার হয়ে ওয়াটারলু স্টেশন পর্যন্ত মিছিল করে—যার দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার বিস্তৃত হয়। যদিও দিনের প্রথম ভাগে মিছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল, বিকেলের পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। রবিনসনের সমর্থকরা পাল্টা মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারতে থাকে এবং নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা চালায়। পুলিশ বাধ্য হয় বলপ্রয়োগ করতে।
প্রসঙ্গত, রবিনসন ইংলিশ ডিফেন্স লিগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্রিটিশ উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির পরিচিত মুখ। অতীতে তিনি একাধিকবার আইনের কবলে পড়েছেন—আদালত অবমাননা, হামলা এবং মর্টগেজ জালিয়াতির অভিযোগে জেল খেটেছেন। গত বছরও তিনি একটি সমাবেশে উপস্থিত থাকতে পারেননি কারণ তখন তিনি সিরিয়ার এক শরণার্থীকে নিয়ে মানহানিকর মন্তব্যের জন্য সাজা ভোগ করছিলেন।
এবারের ‘ইউনাইট দ্য কিংডম’ সমাবেশের বিশাল জমায়েতকে অনেকেই ব্রিটেনে ক্রমবর্ধমান ডানপন্থী উত্থানের প্রতীক হিসেবে দেখছেন। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, অতি ডানপন্থার উত্থান শুধু অভিবাসন প্রশ্নে নয়, বরং দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক বৈষম্য, মজুরি না বাড়া এবং আবাসন সংকটের মতো সামাজিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। শাসকশ্রেণির ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে রবিনসনদের মতো নেতারা অভিবাসীদের ‘দোষারোপ’ করে জনঅসন্তোষকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সতর্ক করে বলছে, ব্রেক্সিট-পরবর্তী অভিবাসন কাঠামো এমনিতেই বহু শ্রমিককে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ওয়ার্ক রাইটস সেন্টার-এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পয়েন্ট বেসড সিস্টেমের কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা নিয়োগকর্তার উপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন এবং এতে তাদের শোষণ বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এত বড় মিছিল সত্ত্বেও রবিনসনের সমাবেশের ভিড় ২০২৩ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্যালেস্তাইনের সমর্থনে মিছিলে উপস্থিত তিন লক্ষ মানুষের তুলনায় অনেক কম। তবুও এই ঘটনাই প্রমাণ করে, ব্রিটেনে জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসীবিরোধী রাজনীতির শক্তি ক্রমশই তীব্র হচ্ছে।
