গোপাল সাহা: শারদ উৎসবের আরেক উৎসব আজ ভাই ফোঁটা। আর আজকের দিনে ভাই বোনের থেকে ফোঁটা নেয় এবং বোন ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ভাইকে ফোঁটা দেয় জমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে। আর এই ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে পালিত হয় মিষ্টি মুখ করে। প্রতিটি ভাই বোনকে মিষ্টিমুখ করায়, আবার বোন ভাইকে। কিন্তু সেই মিষ্টি তৈরি করার উপাদান যদি আকাশছোঁয়া দামে পরিণত হয় তাহলে তো মিষ্টিও চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

 

বলা ভালো, মিষ্টি তৈরির প্রধান উপাদান ছানা। আর সেই উপাদান পরিণত হয়েছে আকাশ ছোঁয়া দামে। যার ফলে মিষ্টি প্রতিটি ভাই-বোনেদের মুখে হাসি ফোটানোর বদলে যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছানার কারণে ভাইফোঁটায় মধ্যবিত্তের হাসি যেন ম্লান হতে বসেছে। আর এই ছানার দামই যদি প্রতি কেজি যদি সেঞ্চুরি হাকায় (৩৪০ টাকা প্রতি কেজি) তাহলে মিষ্টি কি পরিমাণ দাম হবে এবং মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে যাবে সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

 

ভাইফোঁটা কেন পালিত হয় এবং কোথা থেকে তার উৎপত্তি: 

 

ভাইফোঁটার উৎপত্তি হিন্দু পুরাণের কয়েকটি প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে জড়িত। যা ভাই-বোনের অটুট বন্ধনকে উদযাপন করে। এই উৎসবটি মূলত কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে পালিত হয়। যা দীপাবলির দুই দিন পরে আসে। বাংলায় এটি কালীপুজোর পরের দিন 'ভাইফোঁটা' নামে পরিচিত এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়।

 

পুরানের কাহিনি থেকে জানা যায়: 

 

১. শ্রীকৃষ্ণ ও সুভদ্রার কাহিনি: এই উৎসবের উৎপত্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি হলো শ্রীকৃষ্ণের। নরকাসুর নামক রাক্ষসকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে যায়। সুভদ্রা তাকে ফুল, মিষ্টি ও তিলক দিয়ে স্বাগত জানায় এবং দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ দেয়। এই ঘটনা থেকেই বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা (তিলক) লাগানোর রীতি শুরু হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

 

২. যমরাজ ও যমুনার কাহিনি: সূর্যদেব আর ছায়াদেবীর দুই সন্তান ছিল – যম আর যমুনা। যম ছিল মৃত্যুর দেবতা, সব সময় নিজের কাজে ব্যস্ত থাকত। বোন যমুনা খুব ভালবাসতে ভাইকে। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো না বহুদিন। একদিন যমুনা অনুরোধ করল, 'ভাই, একদিন আমার বাড়িতে এসো না?' অনেকদিন পর যম রাজি হল। যমুনা সেদিন নিজের হাতে ভাইয়ের প্রিয় খাবার বানাল কপালে চন্দনের ফোঁটা দিল, আর আরতি করে আশীর্বাদ করল ভাইয়ের মঙ্গল কামনায়। যম এত খুশি হল যে বোনকে আশীর্বাদ দিল — যে ভাই আজকের দিনে নিজের বোনের কাছ থেকে ফোঁটা নেবে, তার আয়ু দীর্ঘ হবে, জীবন ভরে সুখ থাকবে। 

 

সেই থেকেই শুরু হয়েছে ভাইফোঁটার প্রথা। আজও এই দিনটা ভালবাসা, যত্ন আর আশীর্বাদের সঙ্গে পালিত হয়। বোন ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে, আর ভাই প্রতিশ্রুতি দেয় বোনকে রক্ষা করার। ভাইফোঁটা শুধু একটা আচার নয়, এটা ভাই-বোনের অটুট বন্ধনের উৎসব।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: 

 

ভাইফোঁটার মতো উৎসব ভারত, নেপাল ও অন্যান্য দেশে ভাইদুজ, ভাইটিকা বা ভৌবীজ নামে পরিচিত। বাংলায় এটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধ, যেখানে বোনেরা ভাইকে সন্দেশ মিষ্টি (যাতে 'ভাইফোঁটা' লেখা থাকে) খাওয়ায় এবং বিশাল ভোজের আয়োজন করে। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবের প্রতীকীতাকে ব্যবহার করে বাংলা বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জন্য রক্ষাসূত্র বাঁধার অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।

 

এই উৎসব ভাই-বোনের ভালবাসা ও সুরক্ষার প্রতীক, যা প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। 

 

ছানার গায়ে জ্বর কতটা প্রভাব পরল ভাই ফোঁটার মিষ্টিতে? 

 

বাঙালির এই ভাইফোঁটার মতো পবিত্র অনুষ্ঠানে মিষ্টির দামে ও ছানায় জ্বর কি বাদ সাধবে, ভাটা পরবে আনন্দে! এটাই তো এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

ভাইফোঁটার মিষ্টি মুখ এবার যেন কিছুটা তেতোই হয়ে গেল গ্রাম ছাড়িয়ে শহর কলকাতায়। ছানার দামে লেগেছে আগুন! মঙ্গলবার কালনার ছানার পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি ছানার দর একলাফে পৌঁছে যায় ৩৪০ টাকায়। যা এখনও পর্যন্ত রেকর্ড বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। সাধারণত ১৬০-১৬৫ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করা ছানার দাম। এভাবে ট্রিপল সেঞ্চুরি পার করায় অবাক ক্রেতা-বিক্রেতা সকলে।

 

গ্রাম বাংলার নদিয়া জেলার এক বড় ছানার পাইকারি বিক্রেতা যার দোকানে মঙ্গলবার সকাল থেকেই ভিড় উপচে পড়ে। প্রতিদিনই এখান থেকে কালনা, কাটোয়া, দাঁইহাট, পূর্বস্থলী, গুপ্তিপাড়া ও শান্তিপুরের ব্যবসায়ীরা ছানা কিনে নিয়ে যান। শুধু তাই নয়, এখান থেকে কলকাতায় পর্যন্ত সরবরাহ হয় মিষ্টি তৈরির প্রধান উপাদেয় ছানা। সাধারণ দিনে যেখানে ১৫-২০ কুইন্টাল ছানা কেনাবেচা হয়, উৎসবের মরশুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫-৩০ কুইন্টালে, অর্থাৎ এক প্রকার দ্বিগুণ বলা যেতে পারে। বলাবাহুল্য, ভাইফোঁটার আগের দিন থেকে চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে সরবরাহ টান পড়তেই দাম লাফিয়ে ওঠে।

 

"ছানার দাম রেকর্ড গড়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি খুব একটা। কারণ ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান, ভাই হোক কিংবা বোনেরা মিষ্টি কিনছে এবং কিনবেও, কিন্তু কিছুটা পরিমাণে পূর্বের তুলনায় কম। কারণ ভাইফোঁটার মত পবিত্র অনুষ্ঠানে ভাই বোনের অটুট বন্ধনকে আরও মজবুত করতে মিষ্টি ছাড়া অসম্ভব।", এমনটাই জানিয়েছেন শহর কলকাতার দুই মিষ্টি ব্যবসায়ী।  

 

অপরদিকে ছানা প্রস্তুতকারক বলেন, “দুধের দাম, গোরুর খাবারের খরচ—সবই আকাশছোঁয়া। ছানা বিক্রি করে সেই খরচই কোনওভাবে ওঠে। তবে উৎসবের সময় একটু রোজগার হয় ঠিকই। কিন্তু এবারে ছানার দাম যেভাবে আকাশ ছোঁয়া হয়েছে তাতে ভয় হচ্ছে কী হয়।" 

 

অন্যদিকে, গ্রাম বাংলার এক ছানার আরতদার বলেন, “চাহিদা-জোগানের ওপর নির্ভর করেই নিলামের মাধ্যমে দাম ঠিক হয়। সোমবার পর্যন্ত যেখানে ছানার দাম ছিল কেজি প্রতি ২৬৫ টাকা, মঙ্গলবার তা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪০ টাকায়।”

 

এই নজিরবিহীন দামের বৃদ্ধি কিন্তু চিন্তায় ফেলেছে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের। গ্রাম বাংলার এক মিষ্টি ব্যবসায়ী বলেন, “এমন দামে ছানা কিনে ভাল মানের মিষ্টি বানানো কঠিন। তবুও দোকানের সুনাম বজায় রাখতে লাভ কমিয়ে ক্রেতার সাধ্যের মধ্যেই মিষ্টি বিক্রি করছি।”

 

 তবে দামের বাড়বাড়ন্ত থাকলেও শহর থেকে গ্রাম প্রতিটি দোকানেই ভাইফোঁটার বিশেষ মিষ্টির সম্ভার নজর কাড়ার মতো — ক্ষীরকদম, ভাইফোঁটা সন্দেশ, রাজভোগ, রসগোল্লা, ইলিশের পেটি, আম সন্দেশ আরও কত রকমারি সন্দেশ ও মিষ্টির বাহার। তবে দোকানদারদের কথায়, এই বছর ভাল মিষ্টি খেতে গেলে পকেট একটু ঢিলা করতেই হবে।

 

মিষ্টির রাজ্যে ছানাই যে আসল নায়ক, তা ফের একবার প্রমাণিত হল। কিন্তু সেই নায়ক এখন যেন একটু বেশি দামি হয়ে উঠেছে!

 

ছানার বাজারচিত্র এক নজরে: 

 

সাধারণ দিনে দাম: ₹১৬০–₹১৬৫ প্রতি কেজি

 

ভাইফোঁটার আগের দিন দাম: ₹৩৪০ প্রতি কেজি (রেকর্ড)

 

প্রতিদিনের গড় কেনাবেচা: ১৫–২০ কুইন্টাল

 

উৎসবের সময় কেনাবেচা: ২৫–৩০ কুইন্টাল

 

প্রভাব:

 

দুধের দামও ঊর্ধ্বমুখী।

 

মিষ্টির দামে বাড়তি চাপ।

 

দোকানদাররা লাভ কমিয়ে বিক্রি করছেন।

 

এক বিক্রেতার কণ্ঠে, “এবার ভাইফোঁটায় মিষ্টি মুখ হোক, তবে পকেট সামলে!”