গোপাল সাহা: আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে বারোটি রাজ্যে শুরু হয়েছে 'এসআইআর' প্রক্রিয়া। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি এবং তাকে কেন্দ্র করে এবার প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়েছে 'বিএলও'দের। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) বা Special Intensive Revision—এই দুই দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করা কার্যত অসম্ভব বলে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন রাজ্যের বুথ লেভেল অফিসাররা (BLOs)। 

শনিবার কলকাতার কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ শিবিরে হাজির হয়েই বিক্ষোভে সামিল হন একাংশের শিক্ষক-বিএলও। তাঁরা জানিয়েছেন, পড়ানো, পারিবারিক দায়িত্ব, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে এই কাজ অসম্ভব হয়ে উঠছে।

নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ শিবিরে উপস্থিত শতাধিক বিএলওদের দাবি, স্কুলের কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার ফর্ম বিলি ও যাচাই করা অত্যন্ত চাপের। তাঁদের অনেকে সকালে কয়েক ঘণ্টা সফর করে স্কুলে পৌঁছন, তারপর ফের সন্ধ্যায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে—যা তাঁদের পক্ষে শারীরিকভাবে সম্ভব নয় বলেই জানান তাঁরা।

এক শিক্ষিকা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে। রাত দশটার সময় ভোটার তালিকার কাজ করতে পারব না। নিরাপত্তারও ভয় আছে। কমিশন যদি অন-ডিউটি অনুমতি না দেয়, তবে এই কাজ করব না।”

অন্য এক শিক্ষক একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, “প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস, খাতা দেখা, ইন্টারনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি—এসবের ফাঁকে যদি আবার তিনবার করে প্রত্যেক ভোটারের বাড়িতে যেতে হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষও ছাড় দেবে না, তাহলে কোন দিকে যাব। শিক্ষকতা করব নাকি ভোটের কাজ দেখব!”

রাজ্যের অনেক মহিলা বিএলও জানিয়েছেন, তাঁরা বাড়ি-বাইরের কাজ মিলিয়ে চরম চাপের মধ্যে আছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় সদস্যদের কাছ থেকে হুমকিও পাচ্ছেন। তাঁদের আশঙ্কা, রাতে বা একা বাড়ি বাড়ি গেলে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যদিকে রাজ্য নির্বাচনী দপ্তরের বক্তব্য, এই কাজ সারাদেশে একইভাবে চালু রয়েছে, এবং পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, “বিহার, উত্তরপ্রদেশ, এমনকী অন্যান্য রাজ্যেও শিক্ষকরা একইভাবে স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি এসআইআরের কাজ করছেন। প্রতিদিন যদি দশটা পরিবারের কাছে যাওয়া যায়, তাহলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব।”

কমিশনের পরামর্শ, শনিবার ও রবিবার বেশি করে কাজ করলে সপ্তাহের মধ্যে ভারসাম্য রাখা যাবে। তাছাড়া, এই অতিরিক্ত কাজের জন্য অর্থনৈতিক পারিশ্রমিকও বাড়ানো হয়েছে—আগে যেখানে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হত, সেখানে এখন এককালীন ১২ হাজার টাকা, আর সুপারভাইজাররা পাচ্ছেন ১৮ হাজার টাকা।

তবে বিএলওদের একাংশ বলছেন, এই আর্থিক অনুদান বাস্তব কষ্ট মেটাতে পারছে না। তাঁদের বক্তব্য, “টাকা নয়, বাস্তবিক সহানুভূতি দরকার। অন-ডিউটি ঘোষণা করলে এবং নিরাপত্তা দিলে তবেই কাজ সম্ভব।”

প্রসঙ্গত, দেশের ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বর্তমানে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযান চলছে। এই সময়ে প্রতিটি বিএলওকে নির্দিষ্ট বুথ এলাকার অন্তর্গত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভোটার তথ্য হালনাগাদ করতে হয়। কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনও ভোটারকে বাড়িতে না পাওয়া যায়, তবে সেই বাড়িতে সর্বাধিক তিনবার যেতে হবে—যা নিয়েও তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

বিক্ষোভের পর বিএলওদের দাবিগুলি রাজ্য নির্বাচন দপ্তর থেকে দিল্লির কেন্দ্রীয় কমিশন সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্রের খবর। বলাবাহুল্য, রাজ্যের শিক্ষক-বিএলওদের বক্তব্য একটাই, “আমরা পড়াতে চাই, দায়িত্ব পালনও করতে চাই, কিন্তু একই সঙ্গে দুটি পূর্ণকালীন কাজ সম্ভব নয়। পরিবার, নিরাপত্তা, এবং ছাত্রদের পড়াশোনার ক্ষতি—সব কিছুর ভার আমরা একা বইতে পারব না।” এখন দেখার, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তাঁদের এই ক্ষোভ ও দাবি কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।