আজকাল ওয়েবডেস্ক: সাধন বৈরাগ্য ছিলেন প্রেমিক, বাউল এবং লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহক। একসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জাপানে গিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। বিদেশি বাউলরা তাঁর গানে তন্ময় হয়ে বাংলার লোকসঙ্গীত এবং বাউলের জীবনদর্শনকে ভালবেসে বাংলায় থেকে গিয়েছেন। তালিকায় আছেন মাকি কাজুমি,ক্রিস্টিনা থেকে ভারত বা বাংলাদেশের অনেক নামী শিল্পী। তাঁকে স্মরণ করলেন তাঁর আশ্রমবাসীরাই। বুধবার সেখানেই হাজির ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ থেকে অনেকেই।
এদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাউল শিল্পী সাধন দাস বৈরাগ্যর দ্বিতীয় তিরোধান দিবস পালিত হল পূর্ব বর্ধমানের খন্ডঘোষ ব্লকের শশঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের আমরুল বিশ্বমানব পঞ্চবটি আশ্রমে। শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি নিজেও আবার শিল্পী। যাত্রা,নাটকের নিয়মিত চর্চা করেন। ছিলেন পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ অপার্থিব ইসলাম, পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দপ্তরের কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বনাথ রায়, শশঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রিম্পা সাহা প্রামাণিক, খন্ডঘোষ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ শ্যামল পাঁজা-সহ অন্যরা। 'মানববন্ধন' পঞ্চবটি আশ্রমে পৌঁছে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ প্রয়াত সাধন দাস বৈরাগ্যের সমাধিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর প্রয়াত বাউল সম্রাটের বিখ্যাত গান 'আমাদের হৃদয়টা হোক আকাশের মতো' এই গানটিতে অংশ নেন সকলে।' তিনি এদিন বলেন, ' ভেদাভেদ নয় মানবপ্রেম। এই মন্ত্রই তো রেখে গেছেন সাধন বৈরাগ্যর মতো শিল্পীরা।' এদিন আশ্রমে দুপুরের প্রসাদ গ্রহণ করেন মন্ত্রী। সেইসঙ্গে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষও প্রসাদ গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন: সপ্তাহান্তেও ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস বঙ্গে, কবে কোথায় বৃষ্টি বাড়বে জেনে নিন
সাধন দাস বৈরাগ্য 'বাউল সম্রাট' নামে বহুল পরিচিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বাউল সাধক ও গায়ক হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭২ বছর বয়সে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পূর্ব বর্ধমানের আমরুলে তাঁর আশ্রমেই প্রয়াত হন। বর্ধমানের মুক্তিপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে হাটগোবিন্দপুর ও আমরুলে ‘সদানন্দের হাট’ নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯১ সালে তিনি জাপানের ওসাকায় বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করেন। যা আন্তর্জাতিকভাবে তাঁকে স্বীকৃতি এনে দেয়। তাঁর আশ্রমে শতাধিক দেশ ও বিদেশের শিষ্য ও শিষ্যা প্রশিক্ষণ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাপানি মহিলা বাউল শিল্পী মাকি কাজুমি এবং অন্যান্য জাপানিরা।
তিনি নিজস্ব ‘মনের মানুষ’ আখড়া পরিচালনা করতেন। যেখানে বাউল দর্শন ও গান এবং সেইসঙ্গে তাঁর ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করেছেন। মেয়েদের অংশগ্রহণকে তিনি সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর আশ্রমে জাপানি মহিলা বাউলরা উপস্থিত থাকতেন।
তাঁর আখড়ায় বিদ্যমান ছিল মাটির মঞ্চ। শব্দযন্ত্রে মাইক বা বৈদ্যুতিক আলোর তিনি বিরোধী ছিলেন বলেই জানা যায়। মাইকের বদলে শব্দের নিজস্ব মাধুর্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। বাউলদর্শন তাঁর জন্য শুধুমাত্র সঙ্গীত নয়, বরং একটি জীবনদর্শনের ঐতিহ্য ছিল। তিনি মানুষের ভিতরের সোনার 'মনের মানুষ’ খুঁজে বের করতে উৎসাহ দিতেন বলে শোনা যায়। তাঁর গানে দেহতত্ত্ব, যোগতত্ত্ব ও সমন্বিত ধর্মীয় ভাবনাকে অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। তিনি 'আগে মায়ের পূজা করো' ও 'সদা আনন্দেতে মজে থাকো মন'-এর মতো বিখ্যাত গান পরিবেশন করেছেন। ৭২ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি হাটগোবিন্দপুর থেকে আমরুলে আশ্রম স্থাপন করে বাউল সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়েছিলেন বাউল সম্প্রদায় ও তাঁর শিষ্য ও গান প্রেমীরা ।
তিনি ‘বাউল সম্রাট’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন এবং একজন 'গুরুব্যক্তিত্ব' হিসেবে দেশ–বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। সাধন দাস বৈরাগ্য ছিলেন ঐতিহ্যবাহী বাউল সঙ্গীত ও দর্শনের একজন অনন্য প্রতিনিধি। তাঁর মাধ্যমে বাউল দর্শন কেবল রাজ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রাধান্য পেয়েছিল। তাঁর শিক্ষা ও কণ্ঠস্বর আজও অনেক সুরের দিশা দেখায়।
