আজ তেসরা সেপ্টেম্বর ১০০-এ পা দিলেন উত্তমকুমার। তাঁর ঘাড় ঘুরিয়ে, সামান্য চোখ তুলে এক চিলতে হাসিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সিনেপর্দা। যার চলাফেরা, সংলাপ বলার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি- সবকিছুতেই ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি। মারা যাওয়ার পর এত বছর ধরেও তিনি এখনও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে।  প্রায় একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন বাংলা ছবির অভিনয়ের ধারা। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন ছবিলেন তিনি? আনকোরা নতুন সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন? পর্দার অন্য দিকের সেই অচেনা উত্তমকে নিয়ে স্মৃতি হাতড়িয়েছিলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। 

“উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি নগর দর্পণে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই গল্পকে বড়পর্দায় রূপ দিয়েছিলেন পরিচালক দিলীপ মুখার্জি। বলাই বাহুল্য, উত্তমদা ছিলেন নায়ক এবং কাবেরী বসু নায়িকা। আমার চরিত্র ছিল এক লাফাঙ্গা ছেলের, নাম রতন। ভুলভাল কথা বলে মানুষকে ভারী বিরক্ত করে, মেয়েদের পিছনে লাগে। যাই হোক, দীঘার সমুদ্রসৈকতে শুটিং। আমার প্রথম দিনের দৃশ্যই উত্তমকুমারের সঙ্গে। খানিক গরমাগরম অ্যাকশন সিকোয়েন্স। রতন সেই নায়িকাকে সমুদ্রতটে বিরক্ত করছিল, সেই অসভ্যতামো দেখে উত্তমকুমার তাঁকে এক ঘুষি মারে! লজ্জায়, অপমানে রতন ওঁর কলার চেপে ধরবে, শুরু হবে তর্কাতর্কি, আস্ফোলন। এই হল দৃশ্য। শুনে তো খানিক টেনশনই হয়েছিল। উত্তমকুমারের কলার চেপে ধরতে হবে! ভয়ে ভয়েই ছিলাম, তবু পাবলিকের একটা মারের ভয় তো থাকে মনে। 

যাই হোক, পরিচালককে বলেছিলাম, এই দৃশ্যের শুটিংয়ের আগে উত্তমকুমারের সঙ্গে যদি আলাপ করিয়ে দিতে পারেন তাহলে একটু আলোচনা করে সহজ হয়ে যাব। পাশাপাশি, ছবির পরিচালক আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন, সেটারও একটা আলাদা সম্মান আছে। কিন্তু দিলীপদা জানালেন, তিনি পারবেন না ওসব করতে। নিজে গিয়ে আলাপ করতে হবে। শেষমেশ গেলাম। 

উত্তমদার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। নাম বলার পাশাপাশি জানালাম ওই কলার ধরা ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। সঙ্গে এও বলেছিলাম, ওঁর সঙ্গে আগে এক জায়গায় আমার আলাপ হয়েছিল, কিন্তু সেটা মনে রাখার মতো কিছু নয়। আসলে, আমি তখন বহুরূপী দলের হয়ে মঞ্চে চুটিয়ে অভিনয় করি। কলামন্দিরে বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি মঞ্চস্থ করছে ‘বহুরূপী’। ওঁর বাড়ি ময়রা স্ট্রিট কাছেই ছিল, দেখতে এসেছিলেন। শো শেষে আলাপ হয়েছিল। প্রণাম করেছিলাম। ওম্মা, দেখি সেকথা ভোলেননি তিনি। বলেছিলেন, " অত খারাপস্মৃতিশক্তি নয় আমার। তোকে মনে আছে।’ শুনে কী যে খুশি হয়েছিলাম...আমার মত একজন সামান্য অভিনেতাকে উনি মনে রেখেছেন ভেবেই ভাল লেগেছিল। যায় হোক, পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বলল উত্তমদা। সংকোচ হচ্ছিল, ওঁর মত মানুষের পাশে বসব, তাই রাজি হয়নি। শোনামাত্রই গলা তুলে ধমক দিয়েছিলেন – ‘কী বলছি শুনতে পাসনি? কথা কানে যাচ্ছে না? এভাবে কথা বলা যায় না।’ 

শোনামাত্রই তাড়াহুড়ো করে বসেছিলাম। সেই হাসিটা হেসে তারপর উত্তমদা বলেছিলেন, ‘শোন, এটা শুটিং। এখানে তুই বিপ্লব নোস, আমিও উত্তমকুমার নই। তাই অবশ্যই আমার কলার ধরবি  .ভয় পাবি না। অস্বস্তিও নয়।কেমন?’ এই যে আমাকে সাহস, ভরসা দিয়েছিলেন তাতেই এক টেকে উতরে গিয়েছিল ওই সিন। 

শুটিংয়ের সময় আমি এতটাই ওই দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম যে পরিচালক কাট বলার পরেও উত্তমদার কলার ধরেছিলাম। শেষে হালকা হেসে আমার কব্জিতে চাপড় মেরে ছাড়িয়েছিলেন উত্তমদা নিজেই। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘খুব ভাল কাজ করেছিস। ভেরি গুড! এরকম একটা দৃশ্যে যেরকম নাটকীয়তা প্রয়োজন, তুই সেটাই তৈরি করতে পেরেছিস।’”

আসলে, উত্তমদা ছিলেন অন্য জাতের অভিনেতা, অন্য ধরনের মানুষ। প্রথম আলাপেই এত আপন করে নিতে পারতেন, যেন মনে হত কতদিনের চেনা। আর এত অতিথিবৎসল ছিলেন। আর একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। এটা কলামন্দিরের ঘটনা। প্রথমবার আমার সঙ্গে উত্তমদার আলাপ হওয়ার দিনের। শো শেষে আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছিলেন উত্তমদা, গাড়ি নেননি! ভাবতে পারেন! অত রাত্রে ঘর ঘুরিয়ে অনেকে দেখছিলেন তবে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁদের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে এটা উত্তমকুমারই যাচ্ছেন কি না। যাই হোক, উত্তমদা ওসব পরোয়া করতেন না। নিরাপত্তারক্ষীও রাখতেন না। কোনওদিন দেখিনি। তবে আজকালকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কথা আলাদা। সবারই দেখি সঙ্গে কত বডিগার্ড...হয়তো নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে রাখলে মার্কেট ভ্যালু তাতে বাড়ে! যাক গে, উত্তমদার আরও এসব প্রয়োজন পড়ত না, কারণ ওঁর কব্জির জোর ছিল সাংঘাতিক! নিয়মিত টেনিস খেলতেন যে। ঠিকঠাক একটা ঘুসি মারলে দু-তিনটে লোককে মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল!”