আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইজরায়েল ও হামাসের সাম্প্রতিক বন্দি বিনিময়ের পরেও ইজরায়েলি কারাগারে এখনও ৯,১০০-রও বেশি প্যালেস্তাইনি বন্দি রয়েছেন, যাদের প্রতি অমানবিক আচরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা। সোমবার, ১৫ অক্টোবর, গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আটক ২০ জন ইজরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়, যা চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকে তৃতীয় বন্দি-বিনিময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এর আগে প্রথম বিনিময়ে যুদ্ধের সূচনার পর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময় ১০৫ জন ইজরায়েলির বিনিময়ে ২৪০ জন প্যালেস্তাইনি মুক্তি পান। পরবর্তীতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির বড় বিনিময়ে ৩৮ জন ইজরায়েলির বিনিময়ে ১,৭৭৮ জন প্যালেস্তাইনি মুক্তি পেয়েছিলেন। এই তিন দফা বন্দি-বিনিময়ে মোট ১৬৩ জন ইজরায়েলি নাগরিকের বিনিময়ে ৩,৯৮৫ জন প্যালেস্তাইনি বন্দিকে মুক্ত করা হয়েছে।
তবু এই মুক্তি-পর্বের পরেও ৯,১০০-রও বেশি প্যালেস্তাইনি এখনো বন্দি, যাদের অনেকেই কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই কারাগারে রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এদের অধিকাংশই কঠোর ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন। যুদ্ধ শুরুর আগে ইজরায়েলি কারাগারে প্রায় ৫,০০০ প্যালেস্তাইনি বন্দি ছিল, যা ২০২৫ সালের অক্টোবরে গিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ১১,১০০-তে—এর পর সর্বশেষ মুক্তি কার্যক্রমে কিছুটা হ্রাস পেলেও পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ।
বর্তমানে বন্দিদের মধ্যে ৫২ জন নারী, প্রায় ৪০০ শিশু এবং একাধিক চিকিৎসাকর্মী, সাংবাদিক ও কর্মী রয়েছেন, যাদের অনেককে অস্পষ্ট অভিযোগ যেমন ‘উসকানি’ বা ‘বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ’-এর দায়ে আটক রাখা হয়েছে। পাশাপাশি, ৩,৫৪৪ জন প্যালেস্তাইনি প্রশাসনিক আটক (Administrative Detention) আইনে বিচারহীনভাবে অনির্দিষ্ট মেয়াদে বন্দি, আর শত শত গাজাবাসীকে ইজরায়েলের ‘Unlawful Combatant’ আইন অনুসারে আটক করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, এসব বন্দিদের ওপর নিয়মিতভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাদের অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অনাহারে রাখা হচ্ছে, চিকিৎসা ও মৌলিক পরিচ্ছন্নতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৭৮ জন বন্দি এই অমানবিক অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি মুক্তির ঠিক আগে নির্যাতিত বন্দিদের ভিডিও ফুটেজও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
আরও পড়ুন: ফের পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
সোমবার মুক্তি পাওয়া বহু প্যালেস্তাইনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সুস্পষ্ট চিহ্ন বহন করছিলেন। তবে তাদের পরিবারের অনেকেই জানিয়েছেন, এই মুক্তি তাদের কাছে আনন্দের হলেও তাতে এক তিক্ততা মিশে আছে, কারণ মুক্তি পাওয়া অন্তত ১৫৪ জনকে জোর করে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাধ্যতামূলক নির্বাসন প্যালেস্তাইনিদের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে। দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক তামার কারমাউট বলেন, “নিজের দেশ থেকে কাউকে জোর করে বিদেশে পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তারা এক কারাগার থেকে বেরিয়ে আরেক ধরনের বন্দিত্বে প্রবেশ করছে।”
এদিকে গাজার হাসপাতাল পরিচালক ড. হুসাম আবু সাফিয়ার মুক্তি এখনও অনিশ্চিত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইজরায়েলি বাহিনী তাঁকে আটক করেছিল, এবং তাঁর ওপর নির্যাতনের খবর মিলেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, তাঁকে এখনো কোনো অভিযোগ ছাড়াই ইজরায়েলি নিরাপত্তা আইনের অধীনে আটক রাখা হয়েছে।
এক যৌথ তদন্তে জানা গেছে, গাজার প্যালেস্তাইনি বন্দিদের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। ইজরায়েলি সামরিক গোয়েন্দারাও অনুমান করছে, ‘Unlawful Combatant’ আইনে আটক তিন-চতুর্থাংশ প্যালেস্তাইনি হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সক্রিয় সদস্য নন, যা এই আটক অভিযানকে মূলত বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতার বলে নির্দেশ করছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-বিনিময়কে সাময়িক স্বস্তি হিসেবে দেখা হলেও, মানবাধিকার সংস্থাগুলি ইজরায়েলি জেল ব্যবস্থার ওপর আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তুলেছে। আদ্দামির প্রিজনার সাপোর্ট অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী তালা নাসের বলেন, “ইজরায়েল আন্তর্জাতিক রেড ক্রসকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিচ্ছে না, পরিবারদের সাক্ষাতের অধিকার অস্বীকার করছে এবং বন্দিদের মৌলিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করছে না। যুদ্ধ থেমে গেলেই অপরাধ মুছে যায় না—যারা এই নির্যাতনের জন্য দায়ী, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতেই হবে।”
