আজকাল ওয়েবডেস্ক: গাজায় চলমান যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে, খাদ্য ও সাহায্যের সন্ধানে থাকা অসংখ্য নারী এখন নতুন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন—যৌন শোষণ ও প্রতারণা। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (AP)-এর এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই এক শোচনীয় চিত্র, যেখানে নারী আশ্রয়প্রার্থীরা জানিয়েছেন যে, কিছু স্থানীয় পুরুষ—যাদের কেউ কেউ সাহায্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত—খাদ্য, পানি, ওষুধ বা কাজের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তাদের কাছে যৌন সম্পর্ক দাবি করেছে।
৩৮ বছর বয়সী এক গাজাবাসী নারী, ছয় সন্তানের মা, যুদ্ধের শুরু থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছিলেন। এক বন্ধু তাকে জানান যে এক ব্যক্তি সাহায্য করতে পারবেন—খাবার, ওষুধ, এমনকি চাকরিও দিতে পারবেন। ওই নারী, যিনি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন স্বামীর থেকে, ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু চাকরির কথা বলে তাকে একটি ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ব্যক্তি তাকে প্রশংসা করে মাথার ওড়না খুলতে বলেন এবং বলেন যে তিনি তাকে ভালোবাসেন, জোর করবেন না, কিন্তু ছাড়বেনও না। ভয়ে ও লজ্জায় অসহায় নারী পরিস্থিতির সঙ্গে 'মানিয়ে' নিতে বাধ্য হন। যাওয়ার আগে ওই ব্যক্তি তাকে মাত্র ১০০ শেকেল (প্রায় ৩০ ডলার) দেন। চাকরি বা স্থায়ী সাহায্য আর কখনোই আসেনি।
গাজার এই মানবিক সংকট যত গভীর হচ্ছে, ততই বাড়ছে নারীদের প্রতি এই ধরনের শোষণ ও নির্যাতনের ঘটনা। ছয়জন নারী এপি-কে জানিয়েছেন, সাহায্যের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তাদের কাছে যৌন আচরণ দাবি করা হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, সরাসরি বলা হয়েছে—“আমাকে তোমার গায়ে হাত দিতে দাও,” আবার কেউ কেউ ইঙ্গিতে শুনেছেন—“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই,” বা “চলো কোথাও যাই।”
মনোবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতির মতো পরিস্থিতিতে এমন শোষণ নতুন নয়। দক্ষিণ সুদান, বুরকিনা ফাসো, কঙ্গো, চাদ ও হাইতির মতো দেশেও সাহায্য বণ্টনের নামে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর নারী অধিকার বিভাগীয় সহযোগী পরিচালক হিদার বার বলেন, “মানবিক সংকট মানুষের নানা দিক থেকে দুর্বলতা বাড়ায়—যৌন হিংসা তার একটি ভয়াবহ ফলাফল। গাজায় নারীদের অবস্থা এখন অকথ্য।”
আরও পড়ুন: গাজায় কি তবে শান্তি ফিরবে? ট্রাম্পের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন মোদিও, কী বললেন জানেন?
গাজার চারজন মনোবিদ জানিয়েছেন, তাদের কাছে অনেক নারী এমন ঘটনার কথা বলেছেন। কেউ কেউ এমনকি গর্ভবতীও হয়েছেন। তারা বলেন, এই সমাজে বিয়ের বাইরে যৌন সম্পর্ককে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, তাই অধিকাংশ নারী নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভয় পান।
মোট ছয়টি মানবাধিকার ও ত্রাণ সংস্থা—যার মধ্যে স্থানীয় উইমেন্স অ্যাফেয়ার্স সেন্টার ও জাতিসংঘ-সমন্বিত প্রোটেকশন ফ্রম সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন অ্যান্ড অ্যাবিউজ (PSEA) নেটওয়ার্ক অন্তর্ভুক্ত—জানিয়েছে যে তারা এমন ঘটনার রিপোর্ট পেয়েছে যেখানে ত্রাণ পাওয়ার সঙ্গে যৌন শোষণের যোগ রয়েছে। PSEA নেটওয়ার্ক বলেছে, গত বছর তারা গাজায় ১৮টি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে, যেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাহায্যকর্মী বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
এই সংস্থাগুলির মতে, গাজার যুদ্ধ, অবরোধ, এবং প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের বাস্তুচ্যুতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ক্ষুধা ও হতাশা যত বাড়ছে, নারীরা তত বেশি বিপন্ন হচ্ছেন। উইমেন্স অ্যাফেয়ার্স সেন্টারের পরিচালক আমাল সিয়াম বলেন, “ইজরায়েলের অবরোধই নারীদের এমন অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে। তারা সাহায্যের আশায় মরিয়া।”
ইজরায়েল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, গাজায় সাহায্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; বরং হামাসই সেই সাহায্য আটকে দিচ্ছে—যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা দেয়নি।
অন্যদিকে, একজন ৩৫ বছর বয়সী বিধবা নারী জানান, এক ব্যক্তি, যিনি জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা UNRWA-র কর্মী পরিচয়ে তার ফোন নম্বর নিয়েছিলেন, পরে গভীর রাতে ফোন করে অশালীন প্রশ্ন করতেন এবং যৌন প্রস্তাব দিতেন। তিনি অভিযোগ করেন, UNRWA-তে অভিযোগ জানালে তাকে বলা হয়েছিল প্রমাণ দিতে, কিন্তু তার পুরোনো ফোনে কল রেকর্ড করার সুযোগ ছিল না। সংস্থাটি পরে জানায়, তাদের শূন্য সহনশীলতার নীতি আছে এবং প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ নেওয়া হয়।
আরেক নারী বলেন, এক ব্যক্তি যিনি তাকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তাকে UNRWA-তে ছয় মাসের কাজ পাইয়ে দেন, তবে তাদের যৌন সম্পর্কের ঘটনার পর। তিনি এই ঘটনা কখনো অভিযোগ করেননি, কারণ তার বিশ্বাস ছিল—“কেউই বিশ্বাস করবে না, বরং বলবে আমি চাকরির জন্যই মিথ্যা বলছি।”
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যুদ্ধের আগে বছরে এক-দু’টি এমন ঘটনা রিপোর্ট হত, এখন তা বহুগুণ বেড়েছে। অনেক নারী স্বামী বা পরিবারের কাছ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছেন, কেউ কেউ সন্তানদের নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।
নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের গভীরতা যত বাড়ছে, যৌন শোষণের ঘটনাও তত বাড়ছে—আর সমাজের রক্ষণশীল কাঠামোর কারণে বেশিরভাগ ঘটনাই অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।
এক ২৯ বছর বয়সী মা বলেন, “আমার সন্তানদের খাবারের জন্য সাহায্য চাইতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিনিময়ে প্রস্তাব এল বিয়ের নাম করে অশ্লীল কথাবার্তার। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু সেই মানুষটি বারবার বিভিন্ন ফোন থেকে কল করেছে। আমি নিজেকে সম্পূর্ণ অপমানিত বোধ করেছি।”
গাজার এই নারীরা যুদ্ধের আগুনের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করছেন না—তারা লড়ছেন নিজের মর্যাদা, আত্মসম্মান ও মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। মানবিক সহায়তা, যা হওয়া উচিত ছিল তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার প্রতীক, সেটিই আজ অনেকের কাছে ভয়ের আরেকটি নাম হয়ে উঠেছে।
