আজকাল ওয়েবডেস্ক: অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় পাঁচ মাস পর প্রথমবার জ্বালানি পৌঁছাল। রবিবার মিশরের দিক থেকে দুটি ট্রাকে মোট ১০৭ টন জ্বালানি গাজায় প্রবেশ করেছে, কিন্তু সেই স্বস্তির খবরে চাপা পড়ছে না বিপন্ন বাস্তবতা—অসুস্থ, ক্ষুধার্ত, ও নিঃস্ব মানুষের মৃত্যু থামছে না। বিশ্বজুড়ে চাপ ও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ইজরায়েল জ্বালানি প্রবেশে সামান্য ছাড় দিলেও পরিস্থিতি রীতিমতো মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। গাজা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, এখনও সীমান্তে আটকে রয়েছে প্রায় ২২,০০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক, যার অধিকাংশই আন্তর্জাতিক সংস্থার।
জ্বালানি ঢুকল করেম আবু সালেম সীমান্ত দিয়ে
রবিবার দুটি জ্বালানিবাহী ট্রাক করেম আবু সালেম সীমান্ত চেকপয়েন্ট দিয়ে গাজায় ঢোকে। এই সীমান্তটি ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বহু মাস ধরেই বন্ধ ছিল তেল প্রবেশ। এই সপ্তাহের মধ্যেই জাতিসংঘের আরও চারটি ট্যাঙ্কার গাজায় পাঠানো হবে, যা মূলত হাসপাতাল, বেকারি ও পাবলিক কিচেন চালু রাখার জন্য ব্যবহৃত হবে।
আরও পড়ুন: রুশ তেল কিনে ‘যুদ্ধ অর্থ যোগাচ্ছে’ ভারত: ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ সহযোগীর বিস্ফোরক অভিযোগ
৬০০ ট্রাক প্রতিদিন প্রয়োজন, ঢুকছে গড়ে ৩৫
গাজার প্রশাসনের মতে, অন্তত প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক প্রয়োজন ন্যূনতম মানবিক চাহিদা মেটাতে। অথচ ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩৫টি ট্রাক প্রবেশ করেছে গাজা উপত্যকায়। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা COGAT-এর দাবি, নিরাপত্তার কারণে ও হামাসের হাতে থাকা পন বন্দীদের মুক্তির চাপে এই কড়াকড়ি। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে, এটা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করছে এবং ‘বর্ণবাদী অবরোধ’-এর নিদর্শন।
ক্ষুধার্ত জনতার ওপর গুলি, ত্রাণে হামলা, মৃত্যু মিছিল
রবিবারও গাজায় খাদ্যবাহী ট্রাকের ওপর হামলা হয়েছে। তীব্র ক্ষুধার জেরে জনতা ত্রাণ ট্রাকের উপর হুড়োহুড়ি করলে ইজরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়। তাতে কমপক্ষে ২৭ জন মারা যায়। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, জুন মাস থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত ১,৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন শুধু ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে—বা গুলিতে, অথবা পদদলিত হয়ে।
হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই, শিশুদের মরতে হচ্ছে
জ্বালানির অভাবে গাজার হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। সংকটজনক রোগী ছাড়া কাউকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, বলছে রয়টার্স। বিদ্যুৎ না থাকায় ওষুধ সংরক্ষণ, ডায়ালিসিস, আইসিইউ পরিষেবা কিছুই চালানো যাচ্ছে না। গাজা স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ জন মানুষ মারা গেছেন অনাহারে, যার মধ্যে শিশুও রয়েছে। এই পর্যন্ত অনাহারে মোট ১৭৫ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে ৯৩ জনই শিশু। দ্য গার্ডিয়ান এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
“ছায়া দুর্ভিক্ষ”-এর পথে গাজা
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, পরিস্থিতি এক ‘ছায়া দুর্ভিক্ষ’-এর দিকে এগোচ্ছে। খাদ্য সরবরাহ এতটাই কম যে, অনেকে খোলা বাজারে গাছের পাতা ও পশুখাদ্য খাচ্ছেন। UNICEF বলছে, গাজায় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার বেড়ে গিয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেই
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন একের পর এক বিবৃতি দিয়ে ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানালেও বাস্তবে কোনও বড় পরিবর্তন ঘটছে না। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু তা ঢুকছে না। সীমান্তে পড়ে থাকা ট্রাকগুলোর চাকা এখনও গড়ায়নি।” দুই ট্রাক জ্বালানি ঢুকেছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে গাজার লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আসেনি। মৃত্যু ও অপুষ্টির অভিশাপ পিছু ছাড়ছে না গাজার। যতক্ষণ না নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই মানবিক বিপর্যয়ের অবসান নেই—এটাই বাস্তব।
