আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের বৃহত্তম শহরগুলি নয়াদিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতা ও বেঙ্গালুরু ধীরে ধীরে মাটির নিচে ডুবে যাচ্ছে। জনবহুল রাস্তাঘাট ও সুউচ্চ ভবনের নীচে লুকিয়ে থাকা এই বিপর্যয় এখন ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে।


ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের এই পাঁচটি মহানগরের মাটি ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৮৭৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে যাচ্ছে, যা ভবনগুলোর স্থিতি দুর্বল করছে এবং প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের জীবনকে সরাসরি ঝুঁকিতে ফেলছে।


গবেষক সুসান্না ওয়ের্থ, ভার্জিনিয়া টেক-এর ভূবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, বলেন, “যখন কোনো শহর প্রকৃতির পুনঃপূরণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হারে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে, তখন মাটির ভিতর ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হয়। এই স্থানগুলি ধসে পড়লে উপরের মাটিও নিচে বসে যায়।”


জল উত্তোলনের ফলে মাটির স্তর সংকুচিত হয়, ফাঁপা জায়গাগুলো ভেঙে পড়ে, আর সেই সঙ্গে শুরু হয় মাটির ধীরে ধীরে নামা বা "ল্যান্ড সাবসাইডেন্স"। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বর্ষার পরিবর্তিত ধারা। মনসুনের বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পুনঃপূরণও হ্রাস পাচ্ছে।

আরও পড়ুন:  মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব: নতুন নিয়ম আনতে চাইছে সেবি


স্যাটেলাইট তথ্য দেখাচ্ছে, ভারতের মোট জলভান্ডারের পরিমাণও দীর্ঘমেয়াদে হ্রাস পাচ্ছে, যা এখন মহাকাশ থেকেও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে।
দিল্লিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্মাণ হওয়া নদীসঞ্চিত মাটির উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। কিছু এলাকায় যেমন দ্বারকা, সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ প্রকল্পের ফলে সামান্য উন্নতির ইঙ্গিত মিলেছে।


চেন্নাইতে পরিস্থিতি অনেক দ্রুত অবনতির দিকে, বিশেষ করে আডিয়ার নদীর পাড়ে এবং ভালাসারাভাক্কম ও কোডামবাক্কমের মতো কেন্দ্রীয় এলাকায়। এখানকার বালুকাময় ও কাদামাটির মিশ্রণে মাটি সহজেই সংকুচিত হয়। মুম্বইয়ের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল যেমন ধারাভি, অনিয়ন্ত্রিত বোরওয়েল খননের কারণে স্থানীয়ভাবে মাটির অবনমন দেখছে।


বেঙ্গালুরু, যেহেতু শক্ত শিলাস্তরের উপর গড়ে উঠেছে, সেখানে গতি কিছুটা ধীর, তবে ২০২২ সালের পর থেকে অতিরিক্ত জল উত্তোলনের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আধুনিক সুউচ্চ ভবন, কংক্রিটের রাস্তা ও অবকাঠামোর অতিরিক্ত ওজনও মাটির উপর চাপ বাড়াচ্ছে। এই অসম চাপের ফলে ভবনের ভিত্তি বেঁকে যাচ্ছে, দেয়ালে ফাটল ধরছে, পাইপলাইন ভেঙে যাচ্ছে।


স্যাটেলাইট নজরদারি ও উদ্বেগজনক তথ্য
গবেষক দলটি ইন্টারফেরোমেট্রিক সিনথেটিক অ্যাপারচার রাডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১,২০০-রও বেশি স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছে, যাতে মিলিমিটার-স্তরে মাটির নড়াচড়া মাপা সম্ভব হয়েছে। তারা দেখেছেন, প্রায় ২,৪০৬টি ভবন ইতিমধ্যেই বিপদে রয়েছে। যদি পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে, আগামী ৫০ বছরে ২৩,০০০টিরও বেশি ভবন গুরুতর কাঠামোগত ক্ষতির মুখে পড়বে।


শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি শহর একই ধরনের মাটির অবনমন বা "সাবসাইডেন্স"-এর মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাটিকে আরও তীব্র করছে। কখনও অতিবৃষ্টি মাটিকে দুর্বল করছে, আবার কখনও খরা বাড়াচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা।


ভারতের এই নীরব সংকট এখন একটি গ্লোবাল সতর্কবার্তা — যেখানে জল, জমি ও অবকাঠামো একে অপরের সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত। এখনই যদি শহরগুলো তাদের জল ব্যবস্থাপনা নীতি ও নির্মাণ পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে আগামী দশকেই এই “নীরব ডুবে যাওয়া” ভয়ঙ্কর বাস্তবে পরিণত হতে পারে।