আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাঙালির রান্নাঘর মানেই সর্ষের তেলের ঝাঁঝ। আবার হালফ্যাশনে অনেকেই ঝুঁকছেন অলিভ অয়েল বা অন্যান্য সাদা তেলের দিকে। বিজ্ঞাপনের চমক আর স্বাস্থ্য-সচেতনতার যুগে কোন তেল ব্যবহার করবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি প্রায় সব পরিবারেই। কেউ বলেন, ঐতিহ্যবাহী সর্ষের তেলই সেরা, তো কেউ আবার হৃদযন্ত্রের দোহাই দিয়ে বেছে নেন হালকা রিফাইন্ড অয়েল। কিন্তু ভারতীয় রান্না, যেখানে ভাজা, কষানো খাবার এবং ডিপ-ফ্রাইয়ের মতো পদ্ধতির ব্যবহার বেশি, সেখানে সত্যিই কোন তেলটি স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে উপকারী?

 

তেলের উপকারিতা জানতে গেলে আগে ফ্যাট-এর অঙ্কটা বোঝা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও একটি তেলকে সেরা বলার আগে ফ্যাটের প্রকারভেদ বোঝা দরকার। তেলে মূলত তিন ধরনের ফ্যাট থাকে- স্যাচুরেটেড, পলিআনস্যাচুরেটেড (পুফা) এবং মনোআনস্যাচুরেটেড (মুফা)। এর মধ্যে মুফা এবং পুফা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পুফা-এর মধ্যে আবার ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের সঠিক অনুপাত থাকা জরুরি। এছাড়াও রান্নার জন্য তেলের ‘স্মোক পয়েন্ট’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্মোক পয়েন্ট হল সেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, যেখানে তেল উত্তপ্ত হয়ে ভেঙে যায় এবং ক্ষতিকর ধোঁয়া ও রাসায়নিক তৈরি করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক।

 

প্রচলিত তেলের তুল্যমূল্য বিচার

১। সর্ষের তেল

ভারতীয় রান্নাঘরের রাজা বলা চলে সর্ষের তেলকে। পুষ্টিবিদদের মতে, এটি অন্যতম স্বাস্থ্যকর একটি তেল। এতে প্রচুর পরিমাণে মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা মুফা রয়েছে, যা শরীরের জন্য উপকারী। এছাড়া এতে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের অনুপাত খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। এর স্মোক পয়েন্টও অনেক বেশি (প্রায় ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) , ফলে ভাজা বা কষানোর মতো উচ্চ তাপমাত্রার রান্নার জন্য এটি আদর্শ।

২। চিনাবাদামের তেল

পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এই তেলের ব্যবহার খুব বেশি। সর্ষের তেলের মতোই এর স্মোক পয়েন্ট যথেষ্ট বেশি, তাই ডিপ-ফ্রাই করার জন্য এটি উপযুক্ত। এতেও উপকারী মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে। তবে কেনার সময় ‘কোল্ড প্রেসড’ বা ‘ঘানি ভাঙা’ চিনাবাদাম তেল কেনা ভাল।

৩। নারকেল তেল

বিশেষত দক্ষিণ ভারতে এর প্রচলন ব্যাপক। নারকেল তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এতে থাকা মিডিয়াম-চেন ট্রাইগ্লিসারাইড সহজে হজম হয় এবং শক্তি জোগায়। পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করলে এটি ক্ষতিকর নয়।

৪। সাদা বা রিফাইন্ড তেল

এই তেলগুলির নিজস্ব কোনও স্বাদ-গন্ধ না থাকায় অনেকেই এই তেল ব্যবহার করেন। এগুলিতে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট পুফা বেশি থাকে, বিশেষ করে ওমেগা-৬। কিন্তু ওমেগা-৩-এর পরিমাণ খুব কম থাকায় এই তেলের অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন বাড়াতে পারে। তাছাড়া রিফাইনিং প্রক্রিয়ায় তেলের অনেক প্রাকৃতিক গুণ নষ্ট হয়ে যায়।

৫। ঘি

ঘি মূলত স্যাচুরেটেড ফ্যাট হলেও এর উপকারিতা অনেক। এর স্মোক পয়েন্ট খুব বেশি, তাই উচ্চ তাপমাত্রার রান্নায় ঘি আদর্শ। এতে ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে থাকে, যা শরীরের জন্য উপকারী। তবে এটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়াই শ্রেয়।

 

পুষ্টিবিদদের মতে, কোনও একটি তেলকে ‘সেরা’-র তকমা দেওয়া মুশকিল। সবচেয়ে ভাল উপায় হল বিভিন্ন তেল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা। যেমন, এক মাস সর্ষের তেল ব্যবহার করলে পরের মাসে চিনাবাদাম বা তিলের তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে শরীর সব ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডের সুফল পাবে। তবে ভারতীয় রান্নার ধরনের জন্য উচ্চ স্মোক পয়েন্টযুক্ত, কম প্রক্রিয়াজাত এবং মুফা-সমৃদ্ধ তেল, যেমন সর্ষের তেল বা চিনাবাদাম তেল, নিঃসন্দেহে একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। সব শেষে মনে রাখা প্রয়োজন, তেল যতই স্বাস্থ্যকর হোক, তার ব্যবহার হতে হবে পরিমিত। পরিমিতি বোধই সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।