তিনি থাকলে হয়তো শেফলি বর্মার বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরষ্কার নেওয়াই হত না।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ফাইনালে ৫২ রানে জেতার পর ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল ভিকট্রি ল্যাপ দিচ্ছিল, তিনি তখন হুইলচেয়ারে মাঠের একধারে বসে। 

ভাগ্য সঙ্গ দিলে তিনিও হয়তো দলের সঙ্গে গোটা মাঠ ঘুরতেন। ভিকট্রি ল্যাপ দিতেন। ম্যাচ শেষে আনন্দের মুহূর্তে সঞ্চালিকার সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাঁর চোখের কোণায় জল। পাশে দাঁড়িয়ে বাবা, হাতে তাঁর ক্রাচ। তিনি প্রতিকা রাওয়াল।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকে স্মৃতি মান্ধানার সঙ্গে ওপেন করছিলেন। ভারতের অন্যতম ভরসাযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন। গ্রুপ পর্বের ছ’টি ম্যাচে ৩০৮ রান করেন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ পট পরিবর্তন হয়ে যায়। গোড়ালির চোটে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যান প্রতীকা। পরিবর্তে দলে ঢুকে পড়েন শেফালি। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেভাবে দাগ কাটতে না পারলেও, ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁর ৮৭ রানে ভর করেই ২৯৮ রান করতে সক্ষম হয় ভারত। 

চোটের জন্য ছিটকে গিয়েও ক্রমাগত গলা ফাটিয়ে যান তিনি সতীর্থদের জন্য। সেমিফাইনালেও ছিলেন গ্যালারিতে। বাবাকে পাশে নিয়ে একটানা চিয়ার করে গিয়েছেন। ফাইনাল জিততেই মেয়েকে নিয়ে বাবা চলে আসেন মাঠে। হরমনপ্রীত, জেমিমা ছাড়াও একে একে সকলের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে মেত ওঠেন প্রদীপ রাওয়াল। নিজের মেয়ে চোটের জন্য খেলতে না পারলেও বাকিদের জন্য তিনি গর্বিত। তাঁর চোখে মুখে ফুটে ওঠে সেই অভিব্যক্তি। 

সতীর্থরা তাঁকে বেশিক্ষণ হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেননি। তাঁর সামনে এসেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন হরমনপ্রীত, রিচা ঘোষরা। তাঁদের দেখে নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেননি। হুইলচেয়ার থেকে উঠে চোট নিয়ে নাচতে শুরু করেন প্রতিকা। পাশে বাবা তখন দাঁড়িয়ে ক্রাচ হাতে। বিশ্বকাপের ফাইনালে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের জন্য প্রত্যেক সতীর্থকে অভিনন্দন জানালেন। পরে, আবার হুইলচেয়ারে বসে পড়লেন। একটি আবেগঘন সাক্ষাৎকারে চিৎকার করে বলেছিলেন যে এটি কেবল দলের জন্য নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যও একটি বিশেষ মুহূর্ত। 

হুইলচেয়ারে বসে থাকা প্রতিকার দিকে সঞ্চালিকা মাইক্রোফোন এগিয়ে দিতেই তিনি বলে উঠলেন, “মাঠের মধ্যে থাকার থেকে মাঠের বাইরে থাকা বড্ড কঠিন। কিন্তু আমি মাঠের বাইরে থাকলেও উত্তেজনায় পেট গুরগুর করছিল। আসলে এই এনার্জি আপনাকে তাতিয়ে দেবেই।”

তিনি আরও বলেন, “আমি কোনও শব্দে এই আনন্দ প্রকাশ করতে পারব না। আমার কাঁধে এই পতাকার অর্থ অনেক। আমার দলের সঙ্গে এখানে থাকার অনুভূতিই আলাদা। চোট-আঘাত খেলারই অংশ। আমি এখনও এই দলের অংশ হতে পেরে খুব খুশি। আমি এই দলটিকে ভালবাসি। আমরা আসলে এটা করে দেখিয়েছি! আমরাই প্রথম ভারতীয় দল যারা এতদিন পর বিশ্বকাপ জিতেছে। পুরো ভারত এটার যোগ্য। সত্যি বলতে, নিজে খেলার চেয়ে, খেলা দেখা অনেক কঠিন ছিল। প্রতিটি উইকেট, প্রতিটি বাউন্ডারি- আমার রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। এত দর্শক, এত আবেগ- অবিশ্বাস্য।”

খেলাধুলো বারবার শেখায়, নিজের চেয়ে দলকে সবসময় এগিয়ে রাখতে হবে। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির চেয়ে দলগত সাফল্যকে প্রাধান্য দেওয়ার শিক্ষা দিয়ে যায়। প্রতিকা সেই আদর্শেরই উদাহরণ হয়ে রইলেন বিশ্বকাপ জয়ের মঞ্চে।