আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রায় দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর মার্কিন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যৌথভাবে গাজার যুদ্ধ শেষ করতে একটি ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। সোমবার প্রকাশিত এই পরিকল্পনায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের বিনিময়ে ইজরায়েলে বন্দি প্যালেস্তাইনিদের মুক্তি, ধাপে ধাপে ইজরায়েলি বাহিনীর গাজা থেকে প্রত্যাহার, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের কথা বলা হয়েছে।
সৌদি আরব, জর্ডন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মিশর—এই আটটি দেশ প্রস্তাবটিকে নীতিগতভাবে স্বাগত জানিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে সকলেরই মত, হামাসকে এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করলে পরিকল্পনা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গাজায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রস্তাবকে ঘিরে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দক্ষিণ গাজার বাসিন্দা ইব্রাহিম জৌদেহ এএফপিকে বলেন, “এই পরিকল্পনা অবাস্তব। হামাস কখনোই এই শর্ত মানবে না, আর এর মানে আমাদের জন্য যুদ্ধ ও কষ্ট চলতেই থাকবে।”
অন্যদিকে আবু মাজেন নাসার বলেন, “এটা নিছক প্রহসন। বন্দিদের মুক্তি মানে যদি যুদ্ধ বন্ধের নিশ্চয়তা না থাকে, তবে এর কোনো মানে হয় না।”
আরও পড়ুন: আমেরিকার বাইরে তৈরি সিনেমার উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক বসালেন ট্রাম্প, কতটা ক্ষতি হবে ভারতীয় শিল্পের
সম্প্রতি প্যালেস্তাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনা সমর্থন করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার হামাসকে আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনাটি মেনে নিয়ে যুদ্ধ শেষ করতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও একই সুরে বলেছেন, “হামাসের আর কোনো বিকল্প নেই।”
ওবামা ও বাইডেন প্রশাসনের কূটনীতিকরাও পরিকল্পনাকে “সুযোগসন্ধানী কিন্তু কার্যকর সম্ভাবনাময়” বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কর্মকর্তা ব্রেট ম্যাকগার্ক বলেছেন, “ইজরায়েল ও আরব-ইসলামি দেশগুলো পরিকল্পনা সমর্থন করেছে। এখন সমস্ত আন্তর্জাতিক চাপ হামাসের ওপর পড়া উচিত।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক “বোর্ড অব পিস” অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করবে। তবে এখানে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের অন্তর্ভুক্তি প্যালেস্তাইনি মহলে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্যালেস্তাইন জাতীয় উদ্যোগ দলের নেতা মুস্তাফা বারঘোতি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়েছি। টনি ব্লেয়ারের নাম শুনলেই মানুষ ইরাক যুদ্ধের কথা মনে করে।”
ইজরায়েলে বহু মানুষ এই প্রস্তাবকে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখছেন। তেল আভিভে যুদ্ধবিরতি ও বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত ইনবার হায়মান বলেন, “আমরা আশাবাদী, তবে আবার হতাশ হওয়ার ভয়ও আছে।” ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় মা-বাবাকে হারানো গাল গোরেন বলেন, “ট্রাম্প অন্তত আমাদের কথা শুনেছেন। আমরা চাই এই যুদ্ধ শেষ হোক এবং বন্দীদের ঘরে ফিরিয়ে আনা হোক।”
একই সময়ে গাজায় ইজরায়েলি হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত হলেও অনেকে শান্তির জন্য আশাবাদী। গাজার এক ফেরিওয়ালা আনাস সোরোর বলেন, “যত কষ্টই হোক, আমি এখনো আশাবাদী। কোনো যুদ্ধ চিরদিন চলে না। এবার হয়তো শান্তির সময় এসেছে।”
তবে গাজার বাসিন্দা মহম্মদ আল-বেলতাজি পুরো প্রক্রিয়াকে “একই নাটকের পুনরাবৃত্তি” বলে মন্তব্য করেছেন: “সব সময় দেখা যায় ইজরায়েল রাজি হয়, হামাস রাজি হয় না—অথবা উল্টোটা। খেলা চলে, আর মূল্য চোকায় সাধারণ মানুষ।”
ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও, এর বাস্তবায়ন মূলত নির্ভর করছে হামাসের অবস্থান এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলির বাস্তব রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। দুই বছর ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর সাধারণ প্যালেস্তাইনি ও ইজরায়েলিরা শান্তির খোঁজে মরিয়া হলেও, অতীত অভিজ্ঞতা তাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। এখন দৃষ্টি সবার—এই প্রস্তাব কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নেয় কি না।
