নিজস্ব সংবাদদাতা: মঞ্চেও যেমন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, বলাই বাহুল্য তেমন পর্দাতেও। দীর্ঘ ছ’দশকের অভিনয়ের কেরিয়ারে আপামর বাঙালি দর্শককে অজস্র রঙিন, মনকেমন করা অভিনয়ের স্মৃতি উপহার দিয়ে গিয়েছেন তিনি। তিনি, অনুপ কুমার। সাদা-কালো ছবিতেও যেমন তিনি মাতিয়ে রাখতেন, রঙিন ছবিতেও ঠিক তাই। বলা ভাল, রঙিন ছবিতে আরও রঙিন হয়ে উঠতেন তিনি! এদিন অনুপ কুমারের জন্মদিবসে স্মৃতির অতীতের পাতা উল্টে তাঁর অনুপদা কে দেখলেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
“অনুপদাকে আমি চিনতাম সেই ছোট থেকেই। তখন উনি শ্রীরঙ্গমে অভিনয় করেন। আমি তখন মাথায় দু’টো বিনুনি বেঁধে হাজির হতাম। উনি আমার মাথার বিনুনি দু’টো ঘোড়ার লাগামের মতো ধরে ওঁর সেই বিখ্যাত ভঙ্গিতে হেসে বলে উঠতেন, ‘এই ঘোড়া, হ্যাট হ্যাট।’ আমি এক দৌড়ে পালিয়ে যেতাম। পরে যখন পর্দায় ওঁর বিপরীতে নায়িকা হয়েছি প্রথম দিকে একটু অস্বস্তি হত, কিন্তু উনিই সেটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে অভিনয় নিয়ে তেমন টিপস কখনও দেননি, তবে অন্যভাবে সাহায্য করেন। ধরুন কোনও দৃশ্যের শুটিংয়ের আগে মহড়া দিচ্ছি, উনি নিজের পার্টটুকু করে বলতেন –‘আমি এভাবে করব, তুই কীভাবে করবি দেখা!’ তারপর সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন, নিজের মতামত জানাতেন। আমার কাছে অনুপদা ছিলেন নিজের বড় দাদার মতো আর আমি ওঁর ছোট বোন। এত স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন আমাকে....বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলে কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসতেন। সে ঝুটো মুক্তোর গয়না হোক কিংবা ছোট্ট কানের দুল। গভীর স্নেহ না থাকলে এসব হত না।”
“মানুষকে বড্ড বিশ্বাস করতেন। পরিচিত-অপরিচিত যে কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। আর এত আড্ডাবাজ ছিলেন, উফ কীসব গল্প বলতে পারতেন জমিয়ে। আর এত রসিয়ে মুখভঙ্গি করে বলতেন, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। মেজাজ গরম টরম খুব একটা করতেন না। একটা মজার কথা বলি, ছবির নাম ভুলে গিয়েছি। আউটডোর শুটিংয়ে গিয়েছি। খুব ঠান্ডা। অনুপদা রয়েছে, জহর রায় রয়েছেন। তো জহরদা সন্ধ্যেবেলার পর মদ্যপান করতেন। সেদিন একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন। মদ্যপান করে নিজের সব জামাকাপড় খুলে স্রেফ খাটো প্যান্ট পরে ঠান্ডায় বসে রয়েছেন। সবাই চিন্তায়। অনুপদা খবর পেয়ে দৌড়ল, সঙ্গে আমিও। এরপর জহরদা-কে ছদ্ম বকাবকি করল একচোট। জহরদা মুখ গঞ্জ করে বললেন, ‘আমার গরম লাগছে।’ অনুপদা চুপচাপ নিজের হাতে সব পোশাক ওঁকে পরিয়ে দিলেন। তারপর খাটে শুইয়ে লেপ চাপা দিয়ে দিলেন। এতক্ষণ পুরো চুপ করে ছিলেন জহরদা। যেই অনুপদা বেরোবে, অমনি নিজের সমস্ত জামাকাপড় ফের খুলে ফেললেন। আমি ততক্ষণে দৌড় দিয়েছি সেই জায়গা থেকে আর অনুপদা তো থ!”
“বড্ড মিস করি অনুপদাকে। অভিনেতা হিসেবে উনি কত বড় ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে অনুপদার একটা বড় আক্ষেপ ছিল, বড় বড় পরিচালকেরা সেভাবে ওঁকে ব্যবহার করলেন না। কেন করলেন না, সেটা আমি জানি না। আর বহু দর্শক অনুপ কুমারকে স্রেফ একজন উঁচুমানের কৌতুকাভিনেতা হিসেবে জানেন…এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলি!”
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অল্প কথায় বললেন, “অনুপদা অনেক বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন। মানুষ হিসেবে তার থেকেও ভাল ছিলেন। খুব আড্ডা মারতেন, মজার মজার কথা বলতেন। সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। শেষদিন পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার।”
