আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফের উজ্জ্বল বাংলা সিনেমা! সৌজন্যে, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘নধরের ভেলা’ (The Slow Man and His Raft) ছবি। কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ সাউথ এশিয়া টরন্টো (আইএফএফএসএ টরন্টো) চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিল ‘সেরা ছবি’র (আন্তর্জাতিক) পুরস্কার।

সময়, মানব-ধারণা আর সমাজের গতি নিয়ে এই ছবির কাব্যিক অনুসন্ধানকেই ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের তরফে ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছবিকে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন এক অনন্যসাধারণ ধীর গতির সিনেমাটিক কবিতা হিসেবে, যেখানে এক ‘অতি ধীর’ মানুষ নধর, সার্কাসে অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে খুঁজে ফেরে নিজের জায়গা। তাঁদের কথায়, " চিত্রনাট্যের ধীর তাল, মন্থর অথচ মোহময় গতি, আর প্রতিটি ফ্রেমের ধ্যানমগ্নের ন্যায় সৌন্দর্যর মিশেল এই ছবিকে করেছে গভীর এক মানবিক যাত্রা। যেখানে প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি বিরতি পরিণত হয়েছে অস্তিত্বের কবিতায়।
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য ও তাঁর অসামান্য টিমকে আন্তরিক অভিনন্দন। ‘নধরের ভেলা’ স্রেফ এক সিনেমা নয়, মানবিকতার স্লো সিম্ফনি!”
স্বভাবতই এই খবরে আপ্লুত পরিচালক। তবে তিনি একার কাঁধে এই পিঠ চাপড়ানো নিতে নারাজ। নিজস্ব ছন্দে, স্বল্প কথায় আজকাল ডট ইন-কে তিনি বললেন, “এটা কোনওভাবেই আমার একার কৃতিত্ব নয়। আমার গোটা দলের। সবাই যে আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন, তার জন্যেই এই স্বীকৃতি ‘নধরের ভেলা’ পেল। অবশ্যই এটা খুব জরুরি।”

এর পাশাপাশি এবার এই ছবিটি নির্বাচিত হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (KIFF)-এ। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ইন্টারন্যাশন্যাল কম্পিটিশন: ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস’ বিভাগে। এটাই ওই বিভাগে একমাত্র ভারতীয় ছবি। সেই বিষয়টি নিয়েও অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত তিনি। প্রদীপ্তর কথায়, “প্রথমত, যে ভাষায় ছবিটি তৈরি করেছি, যাঁদের জন্য তৈরি করেছি সেই ভাষার মানুষ দেখবেন, এর থেকে আনন্দের আর কী আছে। বাংলার দর্শককে এই ছবিটা দেখানোটা জরুরি। তাই কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবি প্রদর্শিত হবে, আমরা খুব খুশি।”
‘নধরের ভেলা’ এক ‘মিসফিট’ মানুষের গল্প। সমাজের চোখে যে ‘মিসফিট’। তাঁর ‘অপরাধ’? সে অত্যন্ত ধীরগতি। অলস নয় কিন্তু, ধীরগতির মানুষ। যা-ই সে করে, সমস্তটাই ভীষণ আস্তে আস্তে করে। সেই মানুষটাই পাকেচক্রে ঢুকে যায় এক ভ্রাম্যমান সার্কাসের দলে। সেখানে তার সঙ্গে কী কী ঘটছে, সেই সার্কাসের দলের বাকি শিল্পী, লোকজন তার সঙ্গে কী কী করছে, তাদের অবস্থান কী...তাদের পেশা ও নিজেদের জীবন নিয়ে দোলাচলের মধ্যে এমন একটি মানুষ হাজির হওয়াতে কী হয় শেষমেশ তাই নিয়েই এই ছবি। কথাশেষে তাঁর সংযোজন, “এই ছবির মাধ্যমে কিন্তু সেভাবে আমি গুরুতর বার্তা দিতে চাইনি। যদি কেউ এই ছবি থেকে কোনও বার্তা পান, সেটা তাঁর নিজস্ব অর্জন। তবে এই ছবি দেখলে, দর্শকের অন্যরকম অনুভূতি হবে, এটুকু বলতে পারি।”

ছবিটি শুট হয়েছে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের নিজের গ্রাম নদিয়ার তেহট্টে। নধরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অমিত সাহা, আর সার্কাস ম্যানেজারের চরিত্রে দেখা যাবে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে। পরিচালকের কথায়, “এক অর্থে, অমিত এই ছবির নায়ক আর ঋত্বিক খলনায়ক।”
তিন ঘণ্টার এই সিনেমাটি আগেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে — চলতি বছরের শুরুতে রোটারডাম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (IFFR)-এর ‘হারবার’ বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল ছবিটি।
টরোন্টো থেকে শুরু করে রটারডাম ও কলকাতা- ‘নধরের ভেলা’ ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সময়ের গতি আর মানুষে-মানুষে অমিলের গল্পে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের এই ছবি যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে ধীর হওয়া কোনও দুর্বলতা নয়।
তেহট্টের মাটি থেকে টরোন্টোর পর্দা ঘুরে কলকাতায় আসা – ‘নধরের ভেলা’ এখন সত্যিই ‘গ্লোবাল’ এক যাত্রা।
