পর্দায় তাঁরা বিপ্লবী। ইতিহাসের পাতায় যাঁদের বাস, তাঁদের চরিত্রে প্রাণকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন। ২০২২ সালে ‘৮/১২ বিনয় বাদল দীনেশ’ ছবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্তের চরিত্রকে সেলুলয়েডে জীবন্ত করে তোলেন কিঞ্জল নন্দ এবং অর্ণ মুখোপাধ্যায়। ভারতকে স্বাধীন করতে শহিদ হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মনন-যাপনকে আঁকড়ে নিছক কম উপলব্ধি নয় দুই অভিনেতার। স্বাধীনতার এত যুগ পর সমাজ তথা দেশকে কোন নজরে দেখেন তাঁরা? উত্তর খুঁজল আজকাল ডট ইন।
কিঞ্জল বলেন, “বিনয় বাদল দীনেশ করার জন্য আমায় যে খুব ইতিহাস পড়তে হয়েছে, তা নয়। অল্প পড়তে হয়েছে বটেই। কিন্তু তার থেকেও বেশি বুঝতে হয়েছে ওই মনীষীরা যে জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে যেতেন, সমাজ এবং প্রতি তাঁদের সততাকে। এগুলোকে যদি আমি বিশ্বাস না করি, তবে সেই সত্তাকে আমি কখনওই সেটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারব না।”
শুধু পর্দায় নয়, বাস্তবেও নানা ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে কিঞ্জলের প্রতিবাদী সত্তা। কখনও প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, কখনও আবার প্রশ্ন তুলেছে সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, “আমার মনে হয় ব্যক্তিগত অবক্ষয় হতে হতেই তা সমষ্টিগত অবক্ষয়ের রূপ নিচ্ছে। ভারতবর্ষের যে কোনও জায়গাতেই এই অবক্ষয় দেখা যায়। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ যদি স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করে, পথকুকুরদের খাইয়ে বা কাছের মানুষকে নিয়ে কোনও পোস্ট দেয়, তার কমেন্ট মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায়, সমাজের তথাকথিত শিক্ষিতরাও থাকেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাকরি পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করি। কিন্তু আমরা পড়াশোনার সময় ভারতবর্ষে যে ইতিহাস পড়েছি, তাতে যে সততার কথা, চারিত্রিক গঠন, মানসিক দৃঢ়তার কথা বলা আছে, তা-ই যদি অর্জন না করতে পারি তাহলে সবটাই বৃথা। আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা অর্জন করতে হবে।”
কিঞ্জলের সঙ্গে সহমত অর্ণ। অভিনেতা বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় ইচ্ছেমতো মত প্রকাশ করে দেওয়াটাই স্বাধীনতা নয়। এই স্বাধীনতা আমার চাইনি। আমি অপরাধমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারি না। কারণ সেটা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমার মনে হয় ঘৃণার উৎসবে মেতে ওঠাটাও একটা আদর্শ সমাজের চিত্র নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার যে আঁস্তাকুড়টায় বাস করি, সেটাই আমাদের বাধ্য করে ঘৃণার উদযাপন করতে। এটা করে আমরা নিজেই নিজের স্বাধীনতাকে খর্ব করছি।”
সময়ের সঙ্গে কি তবে মানুষের মননে চেতনার অবক্ষয় ঘটেছে? ম্লান হয়েছে আবেগ? অর্ণের উত্তর, “ছবির শেষ দৃশ্যে যে দিন অভিনয় করছিলাম, সে দিন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। এত কম বয়সের কিছু ছেলে জীবনের কথা না ভেবে প্রাণ দিয়েছিল। আমরা সেটা কখনওই পারব না। সেই মানসিকতাও আমাদের নেই। তারা মূলত এটাই চেয়েছিল যে, ব্রিটিশরা ভারত থেকে বিতাড়িত হোক। সেখানে রাজনীতির থেকেও বেশি ছিল আবেগ। কিন্তু আমি মনে করি রাজনীতিতেও আবেগের জায়গা থাকে।”
কিঞ্জলের মতো অর্ণও সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে আঙুল তুলেছেন। অভিনেতা মনে করেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দেশভাগ এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের পর সমাজে বিবর্তন এসেছে ঠিকই। কিন্তু বর্তমান সময়ে তার কোনও ইতিবাচক ছাপ নেই বললেই চলে। তাঁর কথায়, “সমাজ একেবারে একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের আদতে কোনও স্বাধীনতা নেই। কারও না কারও অঙ্গুলিহেলনে আমরা চলছি। আমরা মনে করছি আমরা স্বাধীন, কিন্তু আমরা কেউই স্বাধীন নই।”
