কয়েক দিন আগের কথা। বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে একটি চিঠিতে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীন দিল্লি পুলিশ। তারপর থেকেই বিতর্ক তুঙ্গে। যে ভাষায় দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচিত তাকে 'বাংলাদেশি ভাষা' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় কী ভাবে? প্রশ্নে মুখর চারদিক। সরব টলিউডও। মাতৃভাষা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেন কৌশিক সেন এবং রূপাঞ্জনা মিত্র।

কৌশিক মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অনুন্নত শিক্ষা এবং চিকিৎসা পরিকাঠামো, চাকরির অভাবের মতো একাধিক সমস্যা আড়াল করতেই তুরুপের তাস ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। নতুন ইস্যু তৈরি করে মূল সমস্যাগুলি থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘুরে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। আজকাল ডট ইনকে কৌশিক বলেন, "এটা শুধু বাংলা এবং বাঙালিকে নিয়ে তৈরি সমস্যা নয়। এটা নির্বাচনের আগে একটা বড় ষড়যন্ত্র। সম্প্রতি কমল হাসান একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেন সনাতন ধর্মের সঙ্গে লড়াই করার একটি মাত্র অস্ত্র হল শিক্ষা। আমি এই কথার সঙ্গে সহমত। আমাদের দেশে স্বাস্হ্য, শিক্ষা, চাকরির, মানুষের নিরাপত্তা, এ সব কিছুই ডামাডোলে আছে। নির্বাচনের আগে মানুষ যাতে এই নিয়ে প্রশ্ন না তুলতে পারে, সেই কারণেই বিজেপি এই ফাটকাটা খেলেছে।"

আগাগোড়াই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে নিয়ে সওয়াল করেছেন কৌশিক। ভাষা নিয়ে তৈরি এই বিতর্কের মধ্যেও সেই আঁচ পাচ্ছেন অভিনেতা। কৌশিকের কথায়, "বিজেপি গোটা ভারতবর্ষের হিন্দুদের কাছে বার্তা পৌঁছতে চায় যে, তারা সংখ্যালঘু অনুপ্রবেশকারীদের আটকাচ্ছে। তা হলে নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভোটের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে বলে আশা করছে তারা। বাংলার তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা কুম্ভমেলায় স্নান করতে গিয়েছেন, সেই বড় অংশটারও বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠবে তারা। এই বছর লক্ষ্য করলাম কুম্ভমেলায় পাপ ধুতে যাওয়ার মানুষের আরও বেড়েছে।"

কৌশিকের মতে, বাংলায় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতির কারণেই বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বিজেপি-র। তিনি বললেন, "পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ব্যর্থতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় না-থাকা একটা শূন্যস্থান তৈরি করছে। আর সেটাকেই হিন্দুত্ব দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা করছে বিজেপি। আমাদের রাজ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে এই বিতর্ক তৈরি করে বিজেপি একটা কার্ড খেলে দেখছে। বোঝানোর চেষ্টা করছে তারা শুধু সংখ্যালঘু অনুপ্রবেশকারীদের ধরছে। কিন্তু বাংলার বাইরে ওরা এই ইস্যুটা থেকে একটা ফলের আশা করছে। তাই মহারাষ্ট্র, বিহারের মতো রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী মানুষকে দেখলেই আক্রমণের কথা বলছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যাদের ধরা হচ্ছে, তারা সকলেই অর্থনৈতির ভাবে দুর্বল। সকলেই দরিদ্র। প্রতিবাদের কোনও উপায় নেই শিক্ষিত, বিত্তবান সঙ্গে কিন্তু এমনটা করা হচ্ছে না।"

কৌশিকের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্র। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় বিজেপি-তে যোগদান করেছিলেন তিনি। তবে পদ্ম-শিবির ত্যাগ করে ফিরে আসেন তৃণমূলে। ২১ জুলাই, ভাষা দিবসের মঞ্চেও দেখা মেলে তাঁর। রূপাঞ্জনার কথায়, "বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। তাকে অসম্মান করার অধিকার এবং দুঃসাহস যাঁরা দেখাচ্ছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলতে রুচিতে বাধে। তবুও বলার মধ্যে এই বলব যে, তাঁরা বাঙালিদের মেধাকে ভয়ে বরাবরই পেয়েছেন। আর তাই আমাদের বাংলার মহিষীদের অবদানকে অস্বীকার করে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কোণঠাসা করার অছিলায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশী ভাষার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে বাংলার মানুষ যাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে আছেন, তাঁদের বিপদে ফেলছেন।"

এখানেই থামেননি অভিনেত্রী। প্রশ্ন ছুড়ে দেন, "আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম অঞ্চলের এক ভাষা, আবার ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে গেলে আলাদা বাংলা ভাষা শোনা যায়। তাহলে কি সেগুলিকেও বাংলাদেশী ভাষা বলবে ওরা?"