পাঁচ দশক পর এবার ফের একবার বড়পর্দায় পা রাখতে চলেছেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’! ছবির পুনরুদ্ধার করা ঝকঝকে সংস্করণটি দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ ‘প্রিয়া’তে ইংরেজি সাবটাইটেল সহ প্রদর্শিত হবে। আগামী ৭ নভেম্বর ফের মুক্তি পাবে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই বিখ্যাত ছবি। প্রদর্শিত হবে চলতি বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও। তার পরের এক সপ্তাহ জুড়ে সারা বাংলা সহ গোটা দেশজুড়ে প্রদর্শিত হবে ‘নায়ক’। অবশ্যই নির্বাচিত সব প্রেক্ষাগৃহে। বাংলার তো বটেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত সত্যজিতের এই কাজ। ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সিমি গারেওয়াল এবং শর্মিলা ঠাকুর। ‘নায়ক’-কে অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের সেরা ছবির তালিকায় রাখেন। দশকে মুক্তি পাওয়ার পর এই ছবি ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল জনতামহলে। সমালোচকরাও অকুন্ঠ প্রশংসায় কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল এই ছবির সমালোচনার পাত্র। পাঁচ দশক পেরিয়ে এবার ফের একবার বড়পর্দায় পা রাখতে চলেছেন নায়ক! ছবির পুনরুদ্ধার করা ঝকঝকে সংস্করণটি রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহে ইংরেজি সাবটাইটেল সহ প্রদর্শিত হবে।

প্রায় ৫৫ বছর আগে সত্যজিতের তৈরি এই ছবির ৪কে রিস্টোরড সংস্করণ এ বছর মে মাসে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব-এ প্রথমবার প্রদর্শিত হয়েছিল। আর এবার, ভারতীয় দর্শকদের জন্য আসছে সেই সংস্করণ। আগামী ৭ নভেম্বর থেকে দেশজুড়ে নির্বাচিত সিনেমা হল ও মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পাবে ছবিটি। এই খবর নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ কলকাতার জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ ‘প্রিয়া’-র কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত। জানিয়ে রাখা ভাল, তাঁর বাবা-মা যৌথভাবে ছিলেন অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির প্রযোজক।

অরিজিৎ দত্ত নিজের ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “অবশ্যই বড়পর্দায় ফের দেখা উচিত এই ছবি... ৭ নভেম্বর থেকে বড়পর্দায় মুক্তি পাবে এই ছবি... আর হ্যাঁ, সারা দেশ জুড়েই মুক্তি পাবে এই ছবি, তবে হ্যাঁ নির্বাচিত কিছু প্রেক্ষাগৃহে।” স্বভাবতই অরিজিৎ দত্তের এই ঘোষণা ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে। আজকাল ডট ইন-কে এ ব্যাপারে অরিজিৎ জানিয়েছেন, কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবি প্রদর্শিত হবে, সেইজন্য তাঁদের তরফে শর্মিলা ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি আসবেন। তার আগের দিন প্রিয়া-তে এই ছবির মুক্তি। এখানেও তাঁর আসার কথা।” কথাশেষে তাঁর সংযোজন, “দর্শক যদি এই ছবিকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেন, তাহলে এক সপ্তাহ কেন, দু-তিন সপ্তাহ চলবে। আমি তো বলব, তার বেশি প্রয়োজন হলেও চলবে। দেখা যাক!”
সত্যজিৎ-পুত্র তথা জনপ্রিয় পরিচালক সন্দীপ রায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন বাবার পরিচালিত ছবির তালিকায় এই ছবিটি তাঁর সবথেকে প্রিয়। কেন? জবাবে সন্দীপ বলেছিলেন, “অনেক তারকার সমাবেশ এই ছবিতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, সিমি গারেওয়াল, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ-সহ সেই সময়ের প্রথম সারির তারকা অভিনেতারা কাজ করেছেন। ছবি জুড়ে বাবার সূক্ষ্ম মনস্তত্বের পরিচয়, যা কখনও উচ্চকিত ভাবে ছবির মূল সুরকে ছাপিয়ে যায়নি।" সন্দীপ তাই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কে তাঁর বাবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বলে দাবি করেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। ছবিটি চার শহুরে যুবকের গল্প যারা কলকাতার কোলাহল থেকে পালিয়ে এক অরণ্যে বেড়াতে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জা ও রবি ঘোষ ছিলেন সেই চার বন্ধুর ভূমিকায়। তাঁদের জীবনে আসে একাধিক নারী চরিত্র -শর্মিলা ঠাকুর, কবেরী বোস এবং সিমি গারেওয়াল। যারা এই চারজনের জীবনের গোপন দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং সম্পর্কের সূক্ষ্ম স্রোতকে উন্মোচন করে।
ছবিটি শুধুমাত্র বন্ধুত্ব বা প্রেম নয়, শহুরে মানসিকতার গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, একাকিত্ব এবং আত্মঅন্বেষণের গল্প। অরণ্যের দিনরাত্রি ছিল এক অর্থে সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে আধুনিক মননের সিনেমাগুলির একটি, যেখানে নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ও প্রকৃতির নীরবতার সংঘর্ষ ফুটে উঠেছিল নিপুণভাবে।
১৯৭০ সালে ছবিটি ২০তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ সেরা ছবির বিভাগে মনোনীত হয়েছিল। তার কয়েক দশক পর, ২০০৩ সালে পরিচালক গৌতম ঘোষ তৈরি করেন এর সিক্যুয়েল আবার অরণ্যে, যেখানে আগের চার বন্ধুদের জীবনের নতুন অধ্যায় ধরা পড়ে।
এ বছর কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এর বিশেষ প্রদর্শনীতে যখন ছবিটি ৪কে ফরম্যাটে পুনরায় দেখানো হয়, উপস্থিত ছিলেন ছবির দুই অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এবং সিমি গারেওয়াল। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা হলিউড পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন, যিনি নিজেও সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা-শৈলীতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। উপস্থিত ছিলেন পূর্ণিমা দত্ত , অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির প্রযোজক সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবেও।
কান-এর পর ছবিটি প্রদর্শিত হয় টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ, যেখানে উত্তর মার্কিনি দর্শকেরাও সাদরে গ্রহণ করেন রায়ের এই ক্লাসিককে।এবার ৭ নভেম্বর থেকে দেশের নির্বাচিত সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে এই নতুন সংস্করণ। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুনে-সহ একাধিক শহরে ছবিটি প্রদর্শিত হবে। চলচ্চিত্র মহলে মত, এটি শুধু একটি পুনরায় মুক্তি নয়, বরং “রায়ের এক চিরন্তন কাজের পুনর্জন্ম”।
ফিল্ম আর্কাইভ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ৪কে রিস্টোরেশনে ছবির প্রতিটি ফ্রেম নতুন দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কালো-সাদা রঙের গভীরতা, আলোছায়ার খেলা, আর অরণ্যের নিস্তব্ধতা -এক কথায়, সব কিছু যেন আরও একবার নতুন প্রজন্মের চোখে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
যেভাবে কান থেকে টরন্টো, আর এখন ভারতজুড়ে এই সিনেমার যাত্রা যেন এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সময় অতিক্রম করা এক শিল্পীর অমর সৃষ্টির। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের ছবিই নয়, এটি এক যুগের অনুভূতি, যা আজও মন ছুঁয়ে যায়, সময়কে থমকে দেয়, আর প্রকৃতির বুকে ফিরিয়ে দেয় মানুষকে নিজের কাছে।
