আর টলিউড-বলিউড নয়। তুঙ্গাভদ্রা, গোদাবরী পেরিয়ে সোজা টেমস নদীর ধারের শহর লন্ডন থেকে পশ্চিমী বিনোদন দুনিয়ায় পা রাখলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। সহজ কথায়, এবার ইংরেজি ছবি পরিচালনা করতে চলেছেন সৃজিত। ছবির নাম, ‘এলিমেন্টারি মাই ডিয়ার হোমস’। শার্লক হোমস-এর স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জীবনের বিশেষ কিছু ঘটনার কথা পর্দায় ফুটিয়ে তুলবেন টলিপাড়ার ‘ফার্স্ট বয়’! লন্ডনে এক সাংবাদিক বৈঠকে ছবির ঘোষণা সেরেই এ খবর দিলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই পরিচালক। ছবির যৌথ প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছে সৃজিতের ম্যাচকাট প্রযোজনা সংস্থা এবং শাহনাব আলমের ইনভিজিবল থ্রেড।

খুলেই বলা যাক বিষয়টি। এ ছবির নির্যাসে থ্রিল, কোর্টরুম ড্রামা ইত্যাদি থাকলেও তাতে মূলত ফুটিয়ে তোলা হবে শার্লক-স্রষ্টার তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব ও মানবিক দিক। তাঁকে গভীরভাবে চেনা, আবিষ্কার করার এক সেতু হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবে এই ছবি। ‘এলিমেন্টারি মাই ডিয়ার হোমস’ আসবে অন্যান্য আঙ্গিক-ও। পাশাপাশি সমান্তরালভাবে একেবারে সৃজিতীয় ছন্দে চলবে কোনান ডয়েলের সৃষ্ট কল্পজগৎ-ও! অর্থাৎ স্রষ্টার জীবনের গল্পে পা রাখবেন শার্লক হোমস স্বয়ং।

ছবির গল্প ১৯০৬ সালের। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ঘটে এক রহস্যজনক খুন। তদন্তে উঠে আসে এমন সব তথ্য, যা কাঁপিয়ে দেয় ডয়েলের নৈতিক বিশ্বাসকে।এর মধ্যেই তাঁর সামনে আসে এক চাঞ্চল্যকর মামলা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত জর্জ এডালজি, যাকে ভুলভাবে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজের কুসংস্কার ও বর্ণবিদ্বেষের আঁধারে বন্দি এই যুবকের গল্প যেন একেবারে শার্লক হোমসের কাহিনির প্রতিচ্ছবি। ডয়েল আর এক মুহূর্ত দেরি করেন না। কল্পনার গোয়েন্দা নয়, বাস্তবের তদন্তকারী হয়ে নামেন মাঠে। সূক্ষ্ম অনুসন্ধান, অক্লান্ত প্রমাণ–জমাট আর একরোখা ন্যায়ের বিশ্বাসে তিনি প্রমাণ করতে চান যে এডালজি নির্দোষ। সমাজের পক্ষপাত, শ্রেণি–বৈষম্য আর জাতিগত ঘৃণার বিরুদ্ধে শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর সত্যসন্ধানের অভিযান। বিচারের দিন যত ঘনিয়ে আসে, ততই স্পষ্ট হয়, কোনান ডয়েলের জীবন যেন তাঁরই সৃষ্ট চরিত্রের প্রতিফলন। যেমন হোমস অন্ধকারের ভেতর আলো খোঁজেন, তেমনই তিনিও লড়ছেন অন্যায়ের আঁধারে।
একই সময়ে সমান্তরালভাবে ফুটে ওঠে আরেক বাস্তব ঘটনা। অস্কার স্লেটার-র মামলা। হত্যার অভিযোগে ভুলভাবে অভিযুক্ত এই মানুষটির কাহিনি জড়িয়ে যায় ডয়েলের জীবনের সঙ্গেই। এই দুই মামলার টানাপোড়েনে তিনি প্রবেশ করেন এমন এক জগতে, যেখানে ন্যায়বিচার, ব্যক্তিগত সংগ্রাম আর মানবিক মূল্যবোধ মিলেমিশে এক গভীর রহস্যের জাল বুনে দেয়। শেষ পর্যন্ত সত্যের অনুসন্ধানই হয়ে ওঠে তাঁর আসল যাত্রা-এক স্রষ্টার নিজের সৃষ্ট ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠার কাহিনি।
কেন নিজের প্রথম ইংরেজি ছবির বিষয় হিসেবে স্যার আর্থার কোনান ডোয়েল-এর জীবনকেই বেছে নিলেন সৃজিত? পরিচালকের কথায়, “ছোটবেলায় আমার প্রথম শার্লক হোমসের সঙ্গে পরিচয় কিন্তু বেকার স্ট্রিটে নয়, বইয়ের পাতার নীরবতার ভেতরে।ডয়েলের গল্পগুলো শুধু বিশ্লেষণ বা গোয়েন্দাগিরি নয়, আসলে কৌতূহলের অ্যানাটমি। দেখতে শেখার, আরও গভীরভাবে দেখার এক তীব্র প্রয়াস। সেই তাগিদটা আজও রয়ে গেছে আমার।”

লন্ডনে সৃজিতের ‘এলিমেন্টারি মাই ডিয়ার হোমস’ ছবি ঘোষণার সময়ে উপস্থিত ছিলেন বিএফআই বোর্ড অব গভর্নর্স-এর সদস্য মণিকা চাড্ডা, বিএফআই-এর আন্তর্জাতিক প্রধান অ্যাগনিয়েস্কা মুডি, বিএফআই আর্কাইভ প্রধান আরিকে ওকে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান ব্রিওনি হ্যানসেন, এবং বিএফআই কালচারাল রিলেশনস বিভাগের মিরান্ডা গাওয়ার-কিয়ান। কোনান ডয়েল এস্টেটের পক্ষ থেকে উপস্থিতি যেমন ছিল, তেমনই ডয়েল পরিবারের সদস্য রিচার্ড পুলি ও রিচার্ড ডয়েল উপস্থিত ছিলেন।

নির্মাতাদের কথায়, ‘এলিমেন্টারি মাই ডিয়ার হোমস’ কেবল এক জীবনী নয়— এটি কল্পনা, ন্যায়বোধ, এবং নৈতিক সাহসের এক সার্বজনীন উৎসব। সেই ডয়েল, যিনি একদিন শার্লক হোমসকে সৃষ্টি করেছিলেন সত্য খোঁজার জন্য তিনিই এবার পর্দায় ফিরে আসছেন, নিজেরই হাতে তৈরি নায়কের মতো।
তবে ছবির ঘোষণা হলেও কবে থেকে এ ছবির শুটিং শুরু, ছবির কাস্টিং কিংবা মুক্তির তারিখ কিছুই এখনও জানানো হয়নি। সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে হেসে মুখে কুলুপ এঁটেছেন সৃজিত। তবে এই ছবি দেখার জন্য আগ্রহের পারদ এখন থেকেই চড়া শুরু করবে হোমস-প্রেমীদের মধ্যে তা বলার অপেক্ষা রাখে কি?
