আজকাল ওয়েবডেস্ক: ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ আসলে পড়ুয়াদের মানসিক চাপ হ্রাস না কি প্রধানমন্ত্রীর প্রচারযন্ত্র? বাজেট পাঁচ গুণ বেড়ে ৭০ কোটির বেশি! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ বাজেট গত সাত বছরে পাঁচ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রথম সংস্করণের জন্য খরচ হয়েছিল ৩.৬৭ কোটি টাকা, ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৮২ কোটিতে — যা প্রায় ৫২২% বৃদ্ধি। এই কর্মসূচি মূলত পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক চাপ কমাতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শমূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন তা একদিনের ইভেন্টে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রধানত বক্তৃতা, ভিডিও প্রচার ও মোদির ছবির সঙ্গে সেলফির ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই কর্মসূচির অধীনে সারা দেশে বসানো হয়েছে ১,১১১টি সেলফি পয়েন্ট। এর জন্য ব্যয় হয়েছে ২.৪৯ কোটি টাকা (জিএসটি বাদে)। একটি থ্রিডি সেলফি পয়েন্ট বানাতে খরচ হয়েছে ১,২৫,০০০ টাকা, আর টুডি ইউনিটে খরচ পড়েছে ১৫,০০০ থেকে ২১,০০০ টাকা। সেলফি ইউনিটগুলিতে থাকছে প্রধানমন্ত্রীর বিশাল ছবি। ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিল্লির ভারত মন্ডপমে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংস্করণের জন্য ব্যয় হয়েছে ১৪.২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মিডিয়া প্রোডাকশন, ক্যাটারিং, গ্রাউন্ড অ্যাক্টিভেশন, সরাসরি সম্প্রচারের খরচ ধরা আছে। এছাড়া ৯৭.৬৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপন, ট্যাক্সি সার্ভিস, ছাত্র থাকার বন্দোবস্ত, বাস পরিবহন, বই কেনা ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায়।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে কোভিডের সময় এই কর্মসূচি অনলাইনে হলেও সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৬ কোটি টাকা। শুধুমাত্র সার্টিফিকেট ছাপানোর জন্য খরচ হয়েছে ৬.১৯ কোটি টাকা — যা ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র যুগে কাগজ বাঁচানো ও খরচ কমানোর ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্যহীন। অন্যদিকে, স্কুল শিক্ষা ও সাক্ষরতা দফতরের মূল প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। যেমন, জাতীয় মেধা সহায়তা বৃত্তি প্রকল্প (National Means cum Merit Scholarship Scheme) ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবনী শিক্ষা কর্মসূচির (Pradhan Mantri Innovative Learning Programme) সম্মিলিত বাজেট ২০১৮-১৯ সালে ছিল ৫৫৯.৫৫ কোটি টাকা, যা ২০২৫-২৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪২৯ কোটি — প্রায় ২৩.২% হ্রাস।
তাছাড়া, ২০২১ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে জাতীয় প্রতিভা সন্ধান পরীক্ষা (NTSE), যা ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতি বছর দশম শ্রেণির ২,০০০ মেধাবী পড়ুয়াকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত বৃত্তি ও মেন্টরশিপ দিত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সংখ্যালঘুদের জন্য পিএইচডি স্তরে চালু থাকা মৌলানা আজাদ জাতীয় ফেলোশিপ-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ‘পুনর্বিবেচনার’ অজুহাতে। অনুদানের অভাব দেখিয়ে ৬০% অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর বিদেশে পড়ার বৃত্তিও বন্ধ করা হয়েছে। সরকার দাবি করছে, ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার একটি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু বছরে এক দিনের এই কর্মসূচির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়, মোদির ছবি বিশিষ্ট সেলফি পয়েন্ট, সার্টিফিকেট ছাপানোর বিপুল খরচ — সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এটি কি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকৃত আলোচনার প্ল্যাটফর্ম, না কি প্রধানমন্ত্রীর একটি ‘ব্র্যান্ডিং’ কার্যক্রম?
তথ্য অধিকার আইনে বিস্তারিত আর্থিক হিসাব চাইলে সরকার জানিয়েছে, পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে ‘ফিডিউশিয়ারি সম্পর্ক’-এর কারণে তারা খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে বাধ্য নয়। ফলে এর খরচের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যখন পড়ুয়াদের সরাসরি সহায়তাকারী প্রকল্পগুলি অর্থের অভাবে বন্ধ হচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর এক দিনের ইভেন্টে কোটি কোটি টাকা ব্যয় কতটা যুক্তিসঙ্গত — তা নিয়ে সরব হচ্ছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীরা।
