আজকাল ওয়েবডেস্ক: নাগপুরে সাম্প্রতিক হিংসা এবং ‘ছাভা’ সিনেমা মুক্তির পর অরঙ্গজেবের খুলদাবাদের কবর সরানোর দাবির বিতর্ক এখনো থামেনি। এরই মধ্যে বলিউডে মুক্তি পেতে চলেছে আরেকটি ছবি— দ্য তাজ স্টোরি, যা তাজমহলকে “হিন্দু মন্দির” হিসেবে দেখানোর পুরনো এবং অপ্রমাণিত দাবিকে আবারও উসকে দিচ্ছে।
ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। প্রথম টিজারে দেখা যায়, রাওয়াল তাজমহলের গম্বুজ খুলে দিচ্ছেন, আর সেখান থেকে উঠে আসছে পুরাণের দেবতা শিবের প্রতিমূর্তি। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পর চার দিন আগে মুক্তি পায় দ্বিতীয় টিজার, যেখানে নির্মাতারা দাবি করেন যে ছবির উদ্দেশ্য তাজমহলের “রহস্য” উন্মোচন করা, যা নাকি কিছু মানুষের মতে একটি “মন্দির”।
এই দুই টিজারই তাজমহলের ইতিহাসকে বিকৃত করে এক ভুয়ো সমান্তরাল তৈরি করার চেষ্টা করছে— যেখানে সপ্তদশ শতকে শাহজাহানের নির্মিত সমাধি ও তথাকথিত ‘তেজোমহালয়’ মন্দিরের কাল্পনিক গল্পকে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাজমহল আসলে একটি হিন্দু স্থাপনা— এই ধারণার সূত্রপাত ঘটে ১৯৬৫ সালে পি. এন. ওক-এর বই Taj Mahal is a Rajput Palace থেকে। সেখানে তিনি দাবি করেন, তাজমহল মূলত চতুর্থ শতকে নির্মিত এক রাজপুত প্রাসাদ, যা শাহজাহান পরে কবর হিসেবে ব্যবহার করেন। ওক তাঁর যুক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭শ শতকের ফারসি গ্রন্থ পাদশাহনামা-র উদ্ধৃতি দেন, যেখানে বলা হয়েছিল শাহজাহান জয় সিং প্রথমের কাছ থেকে আগ্রার এক জমি কিনে নেন।
কিন্তু ঐ সূত্রেই উল্লেখ আছে যে জমিটিতে জয় সিংয়ের পূর্বপুরুষ রাজা মান সিংয়ের তৈরি একটি ‘মঞ্জিল’ (প্রাসাদ) ছিল— অর্থাৎ সেটি ১৬শ শতকের নির্মাণ, চতুর্থ শতকের নয়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ওক সম্ভবত ফারসি না জানার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বিখ্যাত শিল্প ইতিহাসবিদ গাইলস টিলটসনও ওকের দাবি খারিজ করে বলেন, “তাজমহলের মতো স্থাপত্য গঠনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা মুঘল যুগের আগের ভারতে ছিল না।”
প্রথম দাবিটি ভেস্তে যাওয়ার পর ওক ১৯৮৯ সালে নতুন বই Taj Mahal: The True Story প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি তাজমহলকে ১১৫৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত শৈব মন্দির বলে দাবি করেন, যা নাকি জয় সিং শাহজাহানকে উপহার দেন। ইতিহাসবিদেরা পুনরায় জানান, তাজমহলের স্থাপত্য নিখুঁতভাবে মুঘল ধাঁচের— পিয়েত্রা দুরা কাজ, বাল্বাস গম্বুজ, তিমুরীয় পিসতাক এবং চারবাগ নকশায় গড়া।
ওক এই সব প্রমাণের জবাবে দাবি করেন, ভারতের সমস্ত মুঘল স্থাপনা নাকি আদতে হিন্দু স্থাপনা ছিল— ফলে মুঘল স্থাপত্যও আসলে “হিন্দু স্থাপত্য”! তাঁর এসব দাবি কল্পনাশক্তিতে সমৃদ্ধ হলেও ইতিহাসের কোনো ভিত্তি নেই।
পাদশাহনামা-য় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে জয় সিং শাহজাহানকে তাজমহলের নির্মাণের জন্য মার্বেল এবং রাজমিস্ত্রি সংগ্রহে সহায়তা করেছিলেন— অর্থাৎ সমাধিটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মিত হয়েছিল, কোনো পুরনো মন্দির পুনর্ব্যবহার করা হয়নি। তবুও ওক ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন যে তাজমহল ১২শ শতকে রাজা পরমার দেবের মন্ত্রী শালক্ষণের নির্মিত “তেজোমহালয়” মন্দির।
প্রমাণের অভাবে সুপ্রিম কোর্ট আবেদনটি খারিজ করে দেয়। তবুও এই কল্পকাহিনি থেমে থাকেনি। ২০০৫ সালে অযোধ্যা সদ্ভাবনা সমিতির প্রধান অমরনাথ মিশ্র আবারও আলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন করেন যে তাজমহল নাকি চান্দেলা রাজা পরমার্দির নির্মিত, ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে। আদালত সেই আবেদনও দ্রুত খারিজ করে দেয় প্রমাণের অভাবে।
এই বিভ্রান্তি নিরসনে ২০১৭ সালে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI) স্পষ্টভাবে জানায়, তাজমহল কোনো দিনই মন্দির ছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে এই অযৌক্তিক দাবি বারবার উঠছে কেন? ইতিহাসবিদদের মতে, ইসলামী স্থাপত্যকে “হিন্দু স্থাপনার পুনরুদ্ধার” হিসেবে উপস্থাপন করা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের মূল অংশ, যা মুসলিম শাসনকালের সম্পূর্ণ ইতিহাসকে “দাসত্ব ও দখলের” যুগ হিসেবে দেখাতে চায়।
পি. এন. ওক শুধু তাজমহল নয়, আরও নানা আজগুবি দাবি করেছিলেন— যেমন, খ্রিস্টধর্ম নাকি আসলে “কৃষ্ণনীতি” থেকে এসেছে, কিংবা দিল্লির লালকেল্লা নাকি লালকোট নামে এক হিন্দু দুর্গ। তাঁর এসব দাবি ভাষাগত মিলের ওপর দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ মনগড়া।
আজ যখন সিনেমা ও সামাজিক মাধ্যম ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, তখন এমন সিনেমা মুক্তি পাওয়া যে বিপজ্জনক প্রবণতার ইঙ্গিত দেয় তা স্পষ্ট। ইতিহাসকে মিথ্যে কল্পনায় ঢেকে দেওয়া কেবল একটি মহৎ স্থাপত্যের মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সমাজে বিভেদের আগুনও জ্বালায়।
তাজমহল বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্থাপত্য, যা প্রেম ও শিল্পের প্রতীক। সেটিকে ধর্মীয় কল্পকাহিনির কেন্দ্রে টেনে আনা কেবল ইতিহাস নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিও এক গুরুতর অবমাননা।
