আজকাল ওয়েবডেস্ক: মানব শুক্রাণু এমন এক রহস্যময় গতিতে চলাচল করে, যা দেখে মনে হয় তারা প্রকৃতির অন্যতম মৌলিক নীতি—আইজ্যাক নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে অমান্য করছে। “প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীতে সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে”—এই সূত্রই বিজ্ঞানের এক ভিত্তি। কিন্তু ক্ষুদ্র জীবকোষগুলির সাঁতার যেন এই সূত্রকে বেঁকিয়ে দিচ্ছে।
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত-বিজ্ঞানী কেন্তা ইশিমোতো ও তাঁর সহকর্মীরা সম্প্রতি শুক্রাণু ও অন্যান্য মাইক্রোস্কোপিক জীবের গতিবিধি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালান। তাদের এই গবেষণা ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, অত্যন্ত আঠালো বা ঘন তরল পদার্থের মধ্য দিয়েও মানব শুক্রাণু সহজে সাঁতার কাটতে পারে। সাধারণত এই ধরনের ঘন তরলে যেকোনো বস্তুর শক্তি দ্রুত ক্ষয় হয়, ফলে গতি প্রায় থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু শুক্রাণুর লেজ বা ‘ফ্লাজেলা’ এমনভাবে নড়াচড়া করে যে, তারা খুব সামান্য শক্তি হারিয়ে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।
বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, এই রহস্যের পেছনে কাজ করছে ‘অড ইলাস্টিসিটি’ বা “বিস্ময়কর স্থিতিস্থাপকতা” নামের এক বিশেষ গুণ। এর ফলে শুক্রাণুর লেজ এমন এক ধরনের নমনীয় গতিতে বাঁক নেয়, যা আশেপাশের তরল থেকে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
তবে শুধু এই স্থিতিস্থাপক গুণই পুরো ব্যাখ্যা দেয় না। ইশিমোতো ও তাঁর দল তাঁদের মডেল বিশ্লেষণে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করেন—‘অড ইলাস্টিক মডুলাস’। এটি ফ্লাজেলার অভ্যন্তরীণ গঠন ও যান্ত্রিক গতিবিধির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করে।
গবেষকদের মতে, শুক্রাণু কিংবা শৈবালের মতো জীবের লেজ কেবলমাত্র বাইরে থেকে তরল ঠেলে দেয় না; বরং তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ শক্তি সিস্টেমে এমনভাবে প্রবাহিত হয় যে, সেগুলি ভারসাম্যের বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের গতিশক্তি তৈরি করে। ফলে নিউটনের “সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া” সূত্র এখানে পুরোপুরি কার্যকর থাকে না।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর বাইরে জীবনের সম্ভাবনা! মাত্র ২০ আলোকবর্ষ দূরেই আছে কোন গ্রহ
এই আবিষ্কার শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতের রোবোটিক প্রযুক্তিতেও নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। গবেষক দল জানিয়েছে, এই ধরনের ‘স্ব-চালিত’ গতিবিধি বোঝা গেলে এমন ক্ষুদ্র রোবট তৈরি করা সম্ভব হবে, যারা জীবন্ত কোষের মতো নিজেরাই চলাফেরা করতে পারবে। পাশাপাশি, এই গবেষণার মাধ্যমে পাখির ঝাঁক বা অণুসমষ্টির সম্মিলিত গতির মতো প্রাকৃতিক ঘটনাগুলিকেও আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে।
কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের ভাষায়, “আমরা সহজ মডেল থেকে শুরু করে শুক্রাণু ও শৈবালের বাস্তব তরঙ্গায়িত লেজের নড়াচড়া বিশ্লেষণ করেছি। তাতে দেখা গেছে, তাদের অভ্যন্তরে অ-সমানুপাতিক এবং অ-স্থানীয় আন্তঃক্রিয়াগুলি নতুন ধরনের ‘অড-বেন্ডিং মডুলাস’ তৈরি করে, যা এই গতির মূল রহস্য।”
এই গবেষণা আবারও প্রমাণ করল, ক্ষুদ্রতম জীবের মধ্যেও লুকিয়ে আছে এমনসব জটিল পদার্থবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যা আমাদের প্রচলিত বিজ্ঞানের সূত্রকেও পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।
