গোপাল সাহা

রাজ্য তথা দেশে শিশুদের বিরল রোগের মধ্যে নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম বড় অসুখ অর্থাৎ কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং তার ভয়াবহতা বিরল রোগের একটি অংশ। ২০২৪-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা নিরিখে ৩৩ শতাংশ শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয় । আর সেই সচেতনতা নিয়েই চিকিৎসকদের এক নতুন উদ্যোগ ‘Awareness and Access for Patients with Rare Kidney Diseases’।

শনিবারের এই সম্মেলনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়—

১. প্রারম্ভিক শনাক্তকরণ ও জেনেটিক পরীক্ষা কিডনি এবং জীবন দু’টিই রক্ষা করতে পারে।

২. ন্যাশনাল রেয়ার ডিজিজ পলিসি এবং সেন্টার অফ এক্সিলেন্স-এর মাধ্যমে গ্রুপ–১ রোগীদের জন্য চিকিৎসা সুবিধার পরিধি আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে।

৩. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং সচেতনতা কর্মসূচি হবে ভবিষ্যতের রোগীসেবার নতুন দিগন্ত। 

এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ-এর প্রখ্যাত চিকিৎসক রাজীব সিনহা, চিকিৎসক প্রিয়াঙ্কা পাল, এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক পিনাকী মুখার্জি-সহ একাধিক চিকিৎসকরা। স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে এই রোগের সচেতনতা এবং সঙ্গে সরকারের ও সহযোগিতা একান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেন এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত চিকিৎসকরা।

শিশুদের মধ্যে নেফ্রন ডিজিজ বা বিরলতম কিডনি রোগ কী:

শিশুদের মধ্যে কিছু বিরল নেফ্রন (nephron): সম্পর্কিত রোগের মধ্যে রয়েছে কনজেনিটাল নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম (Congenital Nephrotic Syndrome) এবং নেফ্রোনোফথিসিস (Nephronophthisis)। কনজেনিটাল নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম-এ গ্লোমেরুলাস (glomeruli) সঠিকভাবে কাজ না করার কারণে কিডনির পরিশোধন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন চলে যায়, শরীরে ফোলাভাব আসে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, নেফ্রোনোফথিসিস একটি জেনেটিক বা বংশগত রোগ, যা ধীরে ধীরে কিডনির ক্ষতি ঘটায় এবং বিভিন্ন বয়সে এর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

কনজেনিটাল নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম (Congenital Nephrotic Syndrome): এক ধরনের জন্মগত রোগ। যেখানে কিডনির পরিশোধন ইউনিট অর্থাৎ গ্লোমেরুলাস সঠিকভাবে কাজ করে না। এর ফলে প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন চলে যায়। এর ফলে প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন (Proteinuria), শরীরে ফোলাভাব (Edema), রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি (Hypercholesterolemia), পেটের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে তরল জমে থাকা (Ascites), রক্তে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও ঘন ঘন সংক্রমণ দেখা যায়। এই রোগ সাধারণত শৈশবেই কিডনি বিকল করে দেয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে এটি কিশোর বয়স পর্যন্ত ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে পারে।

নেফ্রোনোফথিসিস (Nephronophthisis): এটি একটি বিরল বংশগত রোগ, যা কিডনির নেফ্রন অংশকে প্রভাবিত করে। এতে কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। উপসর্গের ধরন ও তীব্রতা রোগের শুরু হওয়ার বয়সের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। এর ফলে ধীরে ধীরে কিডনি নষ্ট হয়ে যায় এবং প্রোগ্রেসিভ কিডনি ডিজিজ (progressive kidney disease) দেখা দেয়।

আরও পড়ুন: আদানির সংস্থায় ৩২ হাজার কোটি বিনিয়োগের খবর ভুয়ো, দাবি এলআইসি-র, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে পাল্টা তোপ মহুয়া মৈত্রের

অন্যান্য বিরল নেফ্রনজনিত রোগসমূহ 

  • ফ্যাব্রি ডিজিজ (Fabry Disease): এটি একটি জেনেটিক রোগ, যা ধীরে ধীরে কিডনির ক্ষতি ঘটাতে পারে। ফলে প্রস্রাবে প্রোটিন চলে যায় (Proteinuria) এবং কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে।
  • ডেনিস-ড্রাশ সিন্ড্রোম (Denys–Drash Syndrome): এটি একটি বংশগত অসুখ, যা কিডনিতে টিউমার (tumor) হওয়ার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
  • সিস্টেমিক রোগের কারণে নেফ্রোপ্যাথি (Nephropathies due to Systemic Diseases): কিছু বিরল রোগ যেমন থ্রম্বোটিক থ্রম্বোসাইটোপেনিক পারপুরা (Thrombotic Thrombocytopenic Purpura – TTP) রক্তনালিতে জমাট বাঁধার (clotting) ফলে কিডনির ক্ষতি ঘটাতে পারে।

এই বিষয়ে ICH-এর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক রাজীব সিনহা বলেন,  “এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের পরেই লক্ষণ ধরা পড়বে এমনটা নাও হতে পারে। অনেক সময় ১০ থেকে ১২ বছর বয়স পরও অনেক সময় শিশুদের মধ্যে এই কিডনি রোগের লক্ষণ দেখা যায়। যা বিরল থেকে বিরলতম। যার জন্য সচেতনতা খুবই জরুরি। তার পরিবারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কোন উপসর্গই লক্ষ্য করা যায় না। তার জন্য যতটা সম্ভব নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকা শিশুদের ক্ষেত্রে জরুরি।” 

তিনি আরও বলেন, “রেয়ার ডিসিজ অর্থাৎ বিরলতম রোগের ক্ষেত্রে শিশুদের শুধু মস্তিষ্কজনিত বা নিউরো সমস্যা হবে এমনটা নয়। কিডনিজনিত সমস্যা ও আসতে পারে এবং যা পরবর্তীতে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যার জন্যই আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠান মূলত সচেতনতার বার্তা দেওয়ার জন্য।"

এ বিষয়ে আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে এনআরএস মেডিকেল কলেজের নেফ্রলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক পিনাকী মুখার্জি বলেন, “গর্ভবর্তী অবস্থায় এই বিরলতম রোগ নির্ণয়ে দরকার জেনেটিক টেস্ট এবং আলট্রাসাউন্ড স্ক্রিনিং (USG Screening)। সিস্টিক কিডনী ( CYSTIC KIDNEY) বা অন্য ধরনের কিডনির অসুখ মাতৃগর্ভে ধরা পড়লেও জেনেটিক টেস্ট (Genetic test) এর মাধ্যমে জন্মের পড়ে সনাক্ত করা (confirm) উচিত। অ্যামনিও সেনটেসিস, ক্রনিক ভিলাস বায়োপ্সি যেমন রয়েছে Chromosomal microarony (ক্রোমোসোমাল মাইক্রো অ্যারে) বা whole exome Sequencing (এক্সোম সিকুয়েনসিং) এর মাধ্যমে সঠিক নির্ণয় সম্ভব। এর জন্য দরকার মা বাবার সঙ্গে আলোচনা করা এবং জেনেটিক কাউন্সেলিং।”

তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের জিন শিশুদের মধ্যে আসে জেনেটিক্যালি অর্থাৎ বংশানুক্রমে। তবে সেক্ষেত্রে জরুরী নয় যে সেই শিশুর বাবা-মায়ের এই রোগ আছে কি নেই। বাবা মা এদের এই ধরনের জীন না থাকলেও পূর্বের কোন জিনগত কারণে এই রোগ পরবর্তীতে নানা কারণে ট্রিগার হয়ে প্রকাশ্যে আসে যা অতীব বিপজ্জনক। এই ক্ষেত্রে শিশুদের চিকিৎসা বা শনাক্তকরণের জন্য রাজ্য কিংবা কেন্দ্র সরকারেরও সহযোগিতা অধিক মাত্রায় জরুরি। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি উভয়কেই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো এবং রোগীদের জন্য চিকিৎসা সুবিধার পরিধি আরও বিস্তৃত করা। কারণ এ ধরনের টেস্ট এর ক্ষেত্রে খুবই ব্যয়বহুল যা সাধারণ মানুষের জন্য একপ্রকার অসম্ভব বলা যেতে পারে।”