গোপাল সাহা
সমাজে আজও এমন অসংখ্য শিশু রয়েছে, যাদের আমরা বলি নিউরো-ডাইভারসিটি (বিশেষভাবে সক্ষম বা অটিজম-সম্পন্ন শিশু)। যার পরিধি বিশাল। এদের মধ্যে অটিজিম, এপিলেপ্সি, ইডিএইচডি, সেরিব্রাল পলসি, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটি-সহ বিভিন্ন রকম সমস্যা রয়েছে। এরা অন্যদের মতোই স্বপ্ন দেখে, হাসে, খেলে। কিন্তু, তাদের বেড়ে ওঠার গল্পটা একটু ভিন্ন, একটু বেশি সংবেদনশীল।
শৈশব পেরিয়ে যখন তারা পা রাখে কৈশোরে, তখনই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বয়স ১৫-১৬ বছর পেরোলেই তাদের মধ্যে দেখা দেয় নানারকম আচরণগত পরিবর্তন। যা সাধারণ শিশুদের তুলনায় অনেকটাই আলাদা, অনেক সময় পরিবার ও শিক্ষকদের কাছে অচেনা ও বিস্ময়ের হয়ে ওঠে। কারণ তারা এই সময় অতিমাত্রায় অভাব বোধ করে তাদের সঠিক এক সঙ্গীর। যা সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। নিউরো ডিজাবিলিটির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছেলেদের মধ্যে এই পরিবর্তনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি লক্ষ করা যায়। তাদের আচরণ কখনও হঠাৎ আক্রমণাত্মক, কখনও অতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। অনেক সময় নিজের আবেগ প্রকাশ করতে না পেরে তারা ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
এই সময়টা ঠিক যেন এক সূক্ষ্ম সেতুবন্ধন— শৈশবের সরলতা আর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দায়িত্বের সঙ্গমস্থল। তাই এই পর্যায়ে পরিবারের, শিক্ষকের এবং সমাজের বোঝাপড়া ও সহানুভূতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, একটু যত্ন, একটু ভালবাসা আর সঠিক দিকনির্দেশই পারে এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের জীবনকে আরও উজ্জ্বল ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর করে তুলতে।
ভারতে নিউরো ডিজেবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের অনুপাত
* অটিস্টিক শিশুদের হার- দেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অনুপাত আনুমানিক প্রতি ৩৬ জনে ১ জন থেকে প্রতি ৬৮ জনে ১ জন বলে ধারণা করা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি বলছে, প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৩:১ পুরুষ-নারী অনুপাত দেখা যায়।
* বিশেষভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুর পরিমাণ- ভারতে অনুমান করা হয়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় এক জন কোনও না কোনও শারীরিক, মানসিক বা প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে। অর্থাৎ দেশে প্রায় ৪০ থেকে ৯০ মিলিয়ন (৪ থেকে ৯ কোটি) বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু রয়েছে। সরকারের সর্বশেষ জনগণনা তথ্য অনুযায়ী (২০১১ সালের আদমশুমারি), দেশে ২০ বছরের নীচে প্রায় ৭.৮ মিলিয়ন (৭৮ লক্ষেরও বেশি) শিশু প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে বসবাস করছে।
“বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু” শব্দটি অনেক বিস্তৃত পরিসরের হওয়ায় এর নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে CADRRE-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ১০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিশু কোনও না কোনও ধরনের শেখার সমস্যার সম্মুখীন হয়। লিঙ্গ অনুপাতে প্রতি ১ জন মেয়ের তুলনায় প্রায় ৩ জন ছেলে অটিজমে আক্রান্ত বলে লক্ষ করা গিয়েছে।
সচেতনতা বৃদ্ধি, উন্নত গবেষণা, ও নির্ণয় পদ্ধতির আধুনিকীকরণের ফলে অটিজম শনাক্তের হার বেড়েছে। তবে এখনও অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় না হওয়ার (underdiagnosis) সমস্যা রয়ে গিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
আরও পড়ুন: হার্ট-এ ব্লকেজ ? বাড়িতে বসেই জানতে পারবেন , এই সহজ পরীক্ষায় ধরা পড়বে হৃদরোগের বিপদ
চিকিৎসা কিভাবে হওয়া উচিত বলে মত বিশেষজ্ঞদের?
 
  
 
 প্রথমে ‘লার্নিং ডিসএবিলিটি’ নিয়ে ‘তারে জমিন পর’ ও পরে বিশেষভাবে সক্ষম ‘নিউরো-ডেভলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার’ (শিশুবিকাশের অসুখ) নিয়ে তৈরি ‘সিতারে জমিন পর’ চলচিত্রায়ণে দেখা গিয়েছে ‘নিউরোডাইভার্সিটি’-র বিবিধ রূপ। এই নিউরোডাইভার্সিটির লক্ষণ কিন্তু প্রভূত খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব যেমন আইজ্যাক নিউটন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল। 
এই বিষয়ে আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন চিকিৎসক যশোধরা চৌধুরী। তিনি বলেন, নিউরোডাইভার্সিটি মানুষদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি খুব বিশেষভাবে জরুরি সোশ্যাল মডেল। কারণ নিউরো ডাইভার্স-এর মধ্যে অটিজম, ইডিএইচডি, এপিলেপ্সি, ইন্টালেকচুয়াল ডিজেবিলিটি বিভিন্ন রকম সমস্যা রয়েছে। এদের প্রত্যেকের কিন্তু মনন,বুদ্ধি এক একজনের জন্য এক এক রকম। এই সমস্ত শিশুরা শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়সে পা দিলে তারা চূড়ান্তভাবে একাকীত্ব বোধ করছে, প্রকৃত সঙ্গীর অভাব বোধ করছে। তাঁরা কাজ করছেন, কর্মজীবনে যথেষ্টই সাফল্য। কিন্তু সমাজজীবনে তাঁরা নানাভাবে অবহেলিত। যার ফলে তাঁরা মানসিকভাবে এই পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড পিছিয়ে পড়ছেন বা ভেঙে পড়ছেন। মূলত তাঁরা যখন সঙ্গী খুঁজতে যাচ্ছেন তখন তারা সঠিক সঙ্গী পাচ্ছেন না এবং আরও বেশি করে অবহেলিত কিংবা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বলাবাহুল্য আমাদের দেশে এদের জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই, কিন্তু বিদেশে রয়েছে। তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনমতো বিদেশে পার্টনার খুঁজে পান। কিংবা যাতে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারেন তার জন্য সহযোগিতা করা এবং তার জন্য সামাজিক মাধ্যম পর্যন্ত রয়েছে যেখানে তাদের প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পান। এর খুবই প্রয়োজন আমাদের দেশে।”

তিনি আরও বলেন, “মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে বহু মানুষ নিউরো ডাইভারসিটির মধ্যে দিয়ে রান করছেন। তবে এই ক্ষেত্রে সবটাই যে অসুখ তা নয়। এই ইডিএইচডি কিংবা অটিজম কোনও অসুখ নয়, নিউরো ডিসঅর্ডার। তাদের জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক অ্যাডিকুয়েট প্ল্যাটফর্ম। যেখানে তারা নিজেদের মনের মতো মানুষ খুঁজে পাবেন। তার জন্য একটি সামাজিক মডেল তৈরি করা উচিত যেখানে শুধু মেডিকেল নিড শুধু পূর্ণ হবে না, সেখানে তারা তাদের সঠিক পার্টনারও খুঁজে পাবে। যেখানে তাদের প্রকৃত নিড পূর্ণতা পাবে। প্রচুর এ ধরনের মানুষ রয়েছেন যারা তাদের সঠিক সঙ্গী না পাওয়ার কারণে আরও বেশি করে একাকিত্বে ডুবে যাচ্ছেন। যার কারণে আমাদের সামাজিক সচেতনতা আরও বেশি হওয়া জরুরি।"
এই বিষয়ে প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “নিউরোডাউভার্সিটির মানুষগুলোর প্রেম, পরিণয়, বিবাহ অত্যন্ত গভীর হয়, সম্পর্কের দায়বদ্ধতা অনেক পাকাপোক্ত হয়। তাদের সহমর্মিতা বা ‘এমপ্যাথি’ অনেক বেশি হয়। এই মানুষগুলো আবার অক্ষরে বা লাইন ধরে পড়তে পারেন না, তাই তাদের ‘গ্যাসলাইটিং’ নামক মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। মিথ্যা গল্পের চাদরে মুড়িয়ে নিজেদের স্মৃতি-উপলব্ধিকে ম্যানিপুলেট করে তাদের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগ্রত করেন সুবিধাভোগীরা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অটিজমে আক্রান্ত মানুষেরা প্রায় তিনগুণ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ‘নিউরোডাইভার্জেন্ট’ ব্যক্তিরা প্রায়শই LGBTQIA+. হিসেবে পরিচিত হন। তাদের অনুভূতি, চুম্বকীয় ভালবাসা আরও প্রগাঢ় হয় ও তাদের কাছে সম্পর্কের মূল্য অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি হয়। তাই অটিজম, ADHD ও অন্যান্য ‘নিউরোডাইভার্জেনট’ মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ডেটিং অ্যাপ ‘হাইকি’ (Hiki)।”

তিনি আরও বলেন, “বিজ্ঞান ও সমাজ এখনও তাদের সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়নি। ক্রিস্টিন ম্যাকগিনেস, অটিজমে আক্রান্ত হয়ে তাঁর নিজের জীবনের ‘লাইটবাল্ব’ ও ‘গ্যাসলাইটিং’ এর বর্ণনা দিয়েছেন, আমাদের ‘মি-টু’ অধ্যায়ের মতো। দু’টি মানুষ বা তার ডিএনএ-র প্রতিলিপি যেমন এক হয় না, তেমনি দু’টি ব্রেনের গঠন ও কার্যকারিতাও এক হয় না। তাই তাদের হৃদয়ের মেলবন্ধনে ফুটে ওঠে সেই ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’।”
এ বিষয় নিয়ে আমরা সরাসরি কথা বলেছিলাম শহর কলকাতার এক শিক্ষিকার (স্পেশাল এডুকেটার) সঙ্গে, তিনি বলেন, “বর্তমানে এই নিউরোডাইভারসিটি শিশুদের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর জন্য পরিবারকেই সচেতন হতে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো তাদের শরীরে একটা বয়সের পরে যৌন উত্তেজনা তৈরি হয়, যা খুব স্বাভাবিক বিষয়। আর এই বিষয়টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের থেকে বেশি পুরুষ ব্যক্তিত্বের মধ্যে অধিকমাত্রায় প্রকাশ পায়। কিন্তু তার পরিবার বিষয়টিকে লজ্জার মনে করে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, যা খুবই অন্যায় বা অনৈতিক। যার ফলে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই বিকৃত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। আর সেই বিকৃত প্রতিক্রিয়া নিজেদের অজান্তে এ ধরনের কার্যকলাপ করে থাকে যা সাধারণ মানুষ খারাপ ভাবে নেয়। এই বিষয়টিকে বাবা মায়েদের অধিকমাত্রায় নজরে রাখা এবং পুরুষ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তার বাবা এবং মহিলা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তাদের মায়েদের সচেতন থাকা খুবই জরুরি এবং একই সঙ্গে কম বয়সে তাদের এ নিয়ে সচেতন করা এবং একটা শিক্ষামূলক পাঠ পড়ানো জরুরি। তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি সেই সমস্ত শিশুদের অর্থাৎ স্পেশাল চাইল্ড বা অটিজম বাচ্চাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ আনতে তারা নিজেরাই শিখতে পারবে।”
শিক্ষিকা পারমিতা তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, “এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার আমি বহুবার হয়েছি, বেশ কয়েকবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এই স্পেশাল চাইল্ড বয়স ১৫ থেকে ১৭ কিংবা ১৮ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যারা আমার ওপরে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং আমাকে কাছে পাওয়ার বা নানাভাবে গায়ে হাত দেওয়া ও কামের বহিঃপ্রকাশ করে। যার ফলে আমি নানা বিপদের মুখে পড়লেও সেটাকে ভয় না পেয়ে তাদেরকে ভালবেসে শিক্ষা দেওয়ার বা শেখানোর চেষ্টা করেছি। যেটা প্রত্যেকটি বাবা মায়েদের করা উচিত। না হলে এ ধরনের পরিস্থিতি বারবার ঘটবে এবং এই ধরনের শিশুরা বেশি করে সমাজের মানুষের কাছে অবহেলিত হবে, যা একেবারেই কাম্য নয়। এই সমস্ত শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের বাবা মায়েরা তাদের কাম ভাবকে অবদমিত না করে তাদের এই যৌন উত্তেজনা কে একটি সঠিক সময়ে দিন কিংবা রাত্রে একটি গোপন জায়গায় ঘরের কোন অংশে একটা সময় করে তাদের নিজেদের যৌন উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ করানোর একটা সঠিক ব্যবস্থা করতে পারলে তাহলে সে ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুস্থ জীবন পাবে এই ধরনের শিশুরা। আর এই বিষয়ে সচেতন হওয়া অত্যাধিক মাত্রায় জরুরি তার পরিবার কিংবা তার বাবা মায়েদের।”
