চা! এ দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকাল শুরু থেকে আড্ডা কিংবা কাজের বিরতি-এক কাপ গরম চা ছাড়া যেন দিন অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই পানীয়ের ক্ষেত্রে ভারতের একটি বিশেষত্ব রয়েছে যা বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে একে আলাদা করে তোলে। তা হল দুধ মিশ্রিত চা বা 'দুধ-চা'র প্রতি ভারতীয়দের গভীর ভালবাসা। অবাক লাগলেও একথা সত্যি যে  চা-এ দুধের এমন ব্যাপক ব্যবহার প্রায় শুধুমাত্র ভারতেই দেখা যায়। কিন্তু কেন এমন হয়? এর পেছনে রয়েছে এক বিশেষ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক কারণের জটিল সমাহার।

ভারতীয়দের দুধ-চা-এর প্রতি আকর্ষণ কি স্বাদের সামঞ্জস্য নাকি শুধুই অভ্যাস? প্রথমত, ভারতীয় চায়ের স্বাদের একটি বিশেষত্ব হল এটি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চায়ের চেয়ে অনেক বেশি কড়া বা গাঢ় হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো, কখনও বা মশলার ব্যবহার- এই কারণে চায়ের ট্যানিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ট্যানিন চায়ে একটি তীব্র কষাটে ভাব বা অ্যাস্ট্রিনজেন্সি এনে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কড়া স্বাদকে নরম ও মিষ্টি করে তোলার জন্যই চায়ে দুধ যোগ করার প্রবণতা শুরু হয়। দুধের ফ্যাট ও প্রোটিন এই কষাটে ভাবকে অনেকটাই কমিয়ে পানীয়টিকে আরও উপাদেয় করে তোলে।

আরও পড়ুনঃ উৎসবের মরশুমে জমিয়ে ভূরিভোজে বেড়েছে বদহজমের সমস্যা? ওষুধ খাওয়ার আগে কয়েকটি ঘরোয়া টোটকা মানলেই পাবেন স্বস্তি

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে চায়ের চল শুরু হলেও, প্রথমদিকে এটি ছিল মূলত অভিজাত শ্রেণির পানীয়। কিন্তু যখন চা সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করার চেষ্টা শুরু হয়, তখন দুধ মেশানোর বিষয়টি একটি বড় ভূমিকা নেয়। তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশরা যখন শ্রমিকদের কম দামে নিম্নমানের বা কড়া চা সরবরাহ করত, তখন দুধ ও চিনি মিশিয়ে তার স্বাদ ও মান উন্নত করার চেষ্টা করা হত। ক্রমশ এই অভ্যাসটিই ভারতীয় সংস্কৃতিতে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়।
অন্যদিকে, দুধ ভারতে ঐতিহাসিকভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণেও দুধের ব্যবহার ব্যাপক। ভারতে গরুর দুধের সহজলভ্যতাও চায়ের সঙ্গে এর ব্যবহারকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 

অনেকের মতে, দুধ চা পানের পেছনে পুষ্টির একটি ধারণাও কাজ করে। ভারতীয়দের একটি প্রচলিত ধারণা, দুধ মেশালে চায়ের ক্ষতিকর প্রভাব কমে এবং এটি আরও পুষ্টিকর হয়। যদিও আধুনিক পুষ্টিবিদরা এই ধারণার সম্পূর্ণ সমর্থন করেন না, কারণ চায়ের ট্যানিন দুধের ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিনের শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস এখনও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে দুধ-চা পান করতে উৎসাহিত করে।

বিশ্বের অন্যান্য অংশে যেমন চীন বা জাপানে, যেখানে চায়ের জন্ম সেখানে সাধারণত দুধ ছাড়াই হালকা ফ্লেভারের চা পান করা হয়। ব্রিটিশ সংস্কৃতিতেও যদিও দুধ-চা'র চল আছে, তবে সেখানে তা দুধ ও চা আলাদাভাবে কাপে মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যা ভারতীয় 'চা ফোটানোর' পদ্ধতির চেয়ে ভিন্ন।

সব মিলিয়ে কড়া চায়ের স্বাদ নরম করা, ব্রিটিশদের সরবরাহ করা নিম্নমানের চা পানযোগ্য করে তোলা, ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ এবং পুষ্টির ধারণা-এই সব কিছুর মিশেলেই ভারতে 'দুধ-চা' হয়ে উঠেছে জাতীয় পানীয়ের এক অনন্য রূপ।