আজকাল ওয়েবডেস্ক: চীনকে নাড়িয়ে দিয়েছে এক তরুণীর করুণ কাহিনি। লিয়াওনিং প্রদেশের ২০ বছর বয়সি তরুণী লিন ইয়িংইং কোমা থেকে জেগে উঠে জানালেন, যিনি তার চিকিৎসার জন্য প্রায় ২ লাখ ইউয়ান (প্রায় ২৮ হাজার মার্কিন ডলার) খরচ করেছিলেন, সেই প্রেমিকই আসলে তাকে পিটিয়ে অচেতন করে রেখেছিলেন।

ঘটনাটি ঘটে উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াওনিং প্রদেশে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম লিয়াওশেন ইভনিং নিউজ জানায়, লিন ইয়িংইং ২০১৩ সালে ইন্টারনেটে লিউ ফেংহে নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচিত হন। অল্প দিনেই প্রেম গাঢ় হয় এবং দু’জনে মিলে একটি বেকারি চালু করেন। কিন্তু তাদের প্রেমের গল্প দ্রুতই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে।

একদিন লিউ ফোন করে লিনের বাবাকে জানায়, দোকানে কাজ করার সময় লিন “পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে।” পরে জানা যায়, লিনের গুরুতর মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে এবং তিনি গভীর কোমায় চলে গেছেন।

দুই মাস ধরে লিউ প্রতিদিন লিনের সেবা করেছেন — তার ডায়াপার বদলেছেন, শরীর ঘুরিয়ে দিয়েছেন, মালিশ করেছেন। চিকিৎসার খরচ জোগাতে তিনি প্রায় ২ লাখ ইউয়ানের ঋণ নেন। চিকিৎসকেরা তখন বলেছিলেন, লিন হয়তো আর কখনও জাগবেন না। কিন্তু লিউ ঘোষণা করেছিলেন, “আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার প্রেমিকার পাশে থাকব।”

তার এই আত্মত্যাগের খবর চীনের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়, লিউকে তখন “সবচেয়ে নিবেদিত প্রেমিক” বলে প্রশংসা করা হয়। অর্ধেক  বছর পর অলৌকিকভাবে কোমা থেকে জেগে ওঠেন লিন ইয়িংইং। প্রথমে তাকে লিউ-এর ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর লিউ তার পরিবারকে দেখা করতে বাধা দিতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত লিনের বাবা-মা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন।

আরও পড়ুন: পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, অশুভ ইঙ্গিত দিলেন বিজ্ঞানীরা

কিছুদিনের মধ্যেই লিউ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, বলে যে সে “ঋণ শোধের কাজে বাইরে গেছে।” ২০১৫ সালের এপ্রিলে লিন যখন কিছুটা কথা বলতে পারেন, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে ঠাকুমাকে জানান — “আমি পড়ে যাইনি, লিউ-ই আমাকে মেরেছিল।” লিনের কথায়, বেকারিতে একদিন টানা চার ট্রে রুটি পুড়ে গেলে রেগে গিয়ে লিউ মাথায় রোলিং পিন দিয়ে আঘাত করে। “এরপর আমি শুধু পড়ে যাওয়া, কানে রক্ত বেরোনো আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মনে করতে পারি,” বলেন লিন।

জ্ঞান ফেরার পর লিউ তাকে হুমকি দেয় — “যদি কাউকে বলো, তোমার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলব।” লিন জানান, এটি ছিল না প্রথমবার। আগেও লিউ বহুবার তাকে নির্যাতন করেছে। একবার মোবাইল গেম নিয়ে ঝগড়ার সময় ফোন ভেঙে বুকে ঘুষি মেরেছিল। আরেকবার এমন মারধর করেছিল যে তার মুখ ফুলে গিয়েছিল, ফলে কয়েকদিন হোটেলে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল।

সবকিছু লুকিয়ে রেখেছিলেন লিন, কারণ তিনি বাবা-মাকে চিন্তায় ফেলতে চাননি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে পুলিশ অবশেষে লিউ ফেংহেকে একটি দূরবর্তী শহর থেকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও সে কোনো অনুশোচনা দেখায়নি, বরং বলে — “আমি তো তার চিকিৎসার খরচ দিয়েছি, নিজের ভুল শোধ করার চেষ্টা করেছি।”

লিয়াওনিং আদালত লিউ-কে তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছরের প্রবেশন দেয়। পাশাপাশি লিনের পরিবারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ ৫০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার) পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

বর্তমানে লিন ইয়িংইং সুস্থ হবার  পথে, নিজে নিজে কাজ করতে পারেন। আদালত সম্প্রতি মামলাটির বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। প্রকাশের পরই চীনা সমাজে গৃহহিংসা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সূচনা হয়। অল-চায়না উইমেন’স ফেডারেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালে চীনে গৃহহিংসার হার ৩৫.৭ শতাংশে পৌঁছেছে — যা উদ্বেগজনক।

একজন নেটিজেন লিখেছেন, “লিউ আসলে দ্বিমুখী শয়তান। মহিলারা  যেন কখনও নীরব না থাকে—নিজের অধিকারের জন্য আইনকে আশ্রয় নিন।” আরেকজন মন্তব্য করেন, “লিন আবার নতুন জীবন শুরু করছেন, এটা সত্যিই সাহসিকতার উদাহরণ।”

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, গৃহহিংসা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং এক গভীর সামাজিক ব্যাধি—যার বিরুদ্ধে সমাজের প্রত্যেকের সতর্ক ও সক্রিয় ভূমিকা জরুরি।