আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের জুন মাসে উত্তর ভারতের বহু জেলায় তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গণ্ডি পার করে যায়। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (IMD) একাধিক রাজ্যে ‘ইয়েলো অ্যালার্ট’ জারি করে। এই পরিস্থিতি আর নিছক মৌসুমি সমস্যা নয়—এখন তা রূপ নিচ্ছে এক জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংকটে। মাত্র ২০২৪ সালেই ভারতে ৪০,০০০-এর বেশি হিট স্ট্রোকের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৭০০-র বেশি মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের বড় অংশই ছিলেন ৩৮ কোটি গরমে কাজরত শ্রমজীবী মানুষ—যেমন নির্মাণ, কৃষি ও কারখানা খাতের শ্রমিকরা।

সবচেয়ে বেশি ভুগছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ শ্রমিক স্বীকার করেছেন যে তাঁরা গ্রীষ্মে কাজ করতে গিয়ে বারবার জলশূন্যতা, মাথা ঘোরা, এমনকি জ্ঞান হারানোর মতো সমস্যার মুখে পড়ছেন। ২০২৪ সালে দিল্লির তীব্র তাপপ্রবাহে মাত্র তিন দিনেই মৃত্যু হয় ৫০ জন গৃহহীন মানুষের। অন্যদিকে রাজস্থান ও চেন্নাইতে ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজের সময় হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিও ভয়াবহ। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (CII) জানায়, গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহের সময় উৎপাদনশীলতা গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তাপজনিত কারণে প্রতি বছর ভারতে ৩৪ মিলিয়ন কর্মদিবস নষ্ট হয়, যা শ্রমিকের আয় ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করে।

একাধিক রাজ্য ও শহরে Heat Action Plan (HAP) থাকলেও তার বাস্তব রূপায়ন দুর্বল ও খণ্ডিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পরিকল্পনাগুলি পরামর্শমূলক এবং বাধ্যতামূলক নয়। মাত্র ৩০ শতাংশ HAP-এ স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ থাকে, ফলে অর্থের অভাবে পরিকল্পনাগুলি বাস্তবে রূপ পায় না। এছাড়া সরকারি দপ্তর, এনজিও ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ফলে বহু উদ্যোগ মাঠে নামার আগেই থেমে যায়। ২০২৪ সালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের পরামর্শ—যেমন কাজের সময়সূচী পরিবর্তন, হাইড্রেশন ব্রেক, ও ঠান্ডা বিশ্রামস্থল নির্মাণ—পজিটিভ উদ্যোগ হলেও বাস্তবায়নে বিশাল ফাঁক থেকে গেছে। দিল্লি সরকার দুপুর ১২টা থেকে ৪টার মধ্যে বাইরের কাজ নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দিলেও ৬১ শতাংশ পথবিক্রেতার জন্য কোনও ঠান্ডা অবকাঠামো নেই, ফলে তারা কাজ চালাতে বাধ্য হন।

এই সংকটের মধ্যে কিছু শহরে আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত গড়ে উঠেছে। আহমেদাবাদে Heat Action Plan কার্যকরভাবে মৃত্যুহার কমাতে পেরেছে। জোধপুরে ক্ষতিপূরণ ভিত্তিক মডেল চালু হয়েছে এবং স্থানীয় সিভিল সোসাইটি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। থানে শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক হিট ম্যাপিং-এর মাধ্যমে তাপপ্রবাহ ঝুঁকি চিহ্নিত করে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এইসব ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ জায়গাতেই অর্থ বরাদ্দের অভাবই মূল বাধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য যে BOCW সেস তহবিল রাজ্য সরকার সংগ্রহ করে, তার অন্তত ১ শতাংশ হিট অ্যাকশন প্ল্যান রূপায়নে বরাদ্দ করলে স্থায়ী ও প্রভাবশালী হস্তক্ষেপ সম্ভব।

২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০টি রাজ্য—যেমন তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি—তাপপ্রবাহকে রাজ্য-নির্দিষ্ট দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর ফলে তারা SDRF অর্থাৎ রাজ্য দুর্যোগ তহবিল থেকে অর্থ পেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত Disaster Management Act, 2005 অনুযায়ী তাপপ্রবাহকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এর ফলে ১.২ লক্ষ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় দুর্যোগ তহবিল ব্যবহারযোগ্য নয়, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য।

এই প্রেক্ষাপটে একটি নতুন ও কার্যকর সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে প্যারামেট্রিক ইনসিওরেন্স মডেল। এতে নির্ধারিত তাপমাত্রা (যেমন: ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দুই দিন ধরে) অতিক্রম করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়—জটিল কাগজপত্র বা যাচাইয়ের দরকার নেই। দুটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল: SEWA-এর ২০২৪ সালের প্রকল্পে ৫০,০০০ নারী শ্রমিককে আচ্ছাদিত করা হয় এবং হিটওয়েভের সময় ২.৯২ কোটি ক্ষতিপূরণ বিতরণ করা হয়। অন্যদিকে ICICI Lombard-এর প্রকল্পে আহমেদাবাদে তাপমাত্রা ৪৩.৬ ডিগ্রির বেশি হলে প্রতিজন শ্রমিককে ৭৫০ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। মাত্র ২৫০ টাকা প্রিমিয়াম (DMRF বা BOCW সেস তহবিল থেকে পরিশোধযোগ্য) এই বীমা সরকার চাইলে বিপুল পরিসরে চালু করতে পারে। আধার ও UPI-এর মাধ্যমে সরাসরি আর্থিক লেনদেন সম্ভব, ফলে দালাল বা মাঝপথে বিলম্বের সুযোগ নেই।

তবে শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ নয়, কাজের সময় ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনাও জরুরি। যদি কাজের সময় সকাল ৫টা-১০টা ও সন্ধ্যা ৬টা-১১টা পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়, তবে ৭০% পর্যন্ত তাপঝুঁকি কমানো সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট অবকাঠামো। যেমন, রাতের সময় মেট্রো ও বাস পরিষেবা চালু রাখা, সোলার পাওয়ারে চালিত LED লাইট দিয়ে কাজের জায়গায় নিরাপত্তা বাড়ানো, রাতজাগা খাবারের দোকান চালু রাখা, এবং শিশু থাকা শ্রমিকদের জন্য নাইট-টাইম ডে কেয়ার চালু করা।

এই সমস্ত উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য শুধুমাত্র অর্থ নয়, প্রয়োজন মিউনিসিপ্যাল স্তরের সক্রিয় পরিকল্পনা ও আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়। সরকারকে শুধুমাত্র পরামর্শ দিয়ে থেমে না থেকে হিট স্ট্রেস মোকাবিলায় আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। এর মধ্যে পড়বে—তাপপ্রবাহকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া; কর্মক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত বিশ্রামস্থান, বাধ্যতামূলক হাইড্রেশন ব্রেক, ও তাপ সহিষ্ণু সময়সূচীর মতো নিরাপত্তা মানদণ্ড তৈরি করা; এবং পৌরসভা বাজেটের অন্তত ২ শতাংশ কুল রুফ, ওয়াটার ATM ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দ রাখা। এর পাশাপাশি সরকার যদি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে প্যারামেট্রিক ইনসিওরেন্স সম্প্রসারণ করে, এবং PM-JAY-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শ্রমিকদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে শ্রমিকরা অনেক বেশি সুরক্ষিত হবেন।

২০২৫ সালের গ্রীষ্ম আবারও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাপপ্রবাহ এখন আর ঋতুগত ঘটনা নয়—এটা এক অস্তিত্বের সংকট। শ্রমিকদের প্রাণ বাঁচাতে হলে ব্যবহারিক, ন্যায্য ও অধিকারভিত্তিক নীতি দরকার। Parametric insurance, কাজের সময় পুনর্বিন্যাস, ও নতুন অবকাঠামো—এই সব উদ্যোগ ভারতের শ্রমজীবী জনগণের জন্য সুরক্ষা গড়ে তুলতে পারে। তাপপ্রবাহ থেকে শ্রমিককে রক্ষা করা শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, ভারতের মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যাত্রার এক অপরিহার্য পদক্ষেপ। এখন আর পাইলট প্রকল্প বা পরামর্শ দিয়ে কাজ হবে না—প্রয়োজন জাতীয় স্তরের দৃঢ়তা ও দ্রুত পদক্ষেপ।