আজকাল ওয়েবডেস্ক: এক ঐতিহাসিক রায়ে মাদ্রাজ হাইকোর্ট ঘোষণা করেছে যে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেট ভারতীয় আইনের অধীনে একধরনের ‘সম্পত্তি’ (property), যা ব্যক্তির মালিকানায় থাকতে পারে এবং ‘ট্রাস্ট’-এর মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। এই রায় ভারতের আইনি ইতিহাসে ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত বিরোধ ও বিনিয়োগকারীর অধিকারের ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
রায়টি দেন বিচারপতি এন. আনন্দ ভেঙ্কটেশ। তিনি বলেন, “ক্রিপ্টোকারেন্সি নিঃসন্দেহে একটি সম্পত্তি। এটি দৃশ্যমান নয়, মুদ্রা হিসেবেও কাজ করে না। তবে এটি এমন এক সম্পত্তি, যা উপভোগ, দখল এবং ট্রাস্টের মাধ্যমে ধরে রাখা সম্ভব।”
আরও পড়ুন: জমি বিক্রিতে অস্বীকৃতির জেরে গাড়ি দিয়ে কৃষককে পিষে দিল বিজেপি নেতা! দুই কন্যার উপরেও নিপীড়ন
এই মামলাটি শুরু হয়েছিল এক ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীর আবেদন থেকে। ওই বিনিয়োগকারীর WazirX এক্সচেঞ্জে থাকা XRP টোকেন ২০২৪ সালের এক সাইবার হামলার পর হিমায়িত (frozen) হয়ে যায়। তিনি আদালতে জানান যে তাঁর সম্পদগুলি হ্যাক হওয়া Ethereum টোকেন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, এবং তিনি চান তাঁর পোর্টফোলিও অন্যদের মধ্যে পুনর্বণ্টন না করা হয়।
আদালতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক
এই রায় ক্রিপ্টো খাতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে তিনটি কারণে—
১. ক্রিপ্টোকে “অধিকারভুক্ত সম্পত্তি” হিসেবে স্বীকৃতি,
২. ভারতীয় আদালতের ডিজিটাল সম্পদ সংক্রান্ত বিরোধে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা স্পষ্ট করা, এবং
৩. বিদেশি ইনসোলভেন্সি বা পুনর্গঠন প্রকল্প ভারতীয় বিনিয়োগকারীর অধিকারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না—এ কথা স্পষ্ট ঘোষণা করা।
প্রযুক্তি আইনজীবী রশ্মি দেশপান্ডে বলেন, “এই রায় বিনিয়োগকারীদের নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। অনেকেই এখন ভারতের আদালতে অনুরূপ দাবি দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।” তিনি আরও জানান, সিঙ্গাপুর হাইকোর্ট WazirX-কে ক্রিপ্টো সম্পদের রক্ষক (custodian) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেখানে আইনি লড়াই জটিল হয়ে উঠেছিল।
বিনিয়োগকারীর অধিকারে নতুন সংজ্ঞা
পলিগন ল্যাবসের গ্লোবাল হেড অব পেমেন্টস ঐশ্বর্য গুপ্ত বলেন, “আদালত ‘উপভোগ ও দখলের উপযুক্ত সম্পত্তি’ হিসেবে ক্রিপ্টোকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং এটি আয়কর আইনে উল্লিখিত ভার্চুয়াল ডিজিটাল অ্যাসেটের সংজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত করে বিনিয়োগকারীর অধিকার, রক্ষকের দায়বদ্ধতা এবং নিয়ন্ত্রক নিশ্চয়তার একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।”
“ওয়েব৩ আইনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত”
ক্রিপ্টো বিশেষজ্ঞ শরৎ চন্দ্র তাঁর লিঙ্কডইন পোস্টে এই রায়কে “ভারতের ক্রিপ্টো বিচারব্যবস্থার মোড় ঘোরানো মুহূর্ত” বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, যদি বিনিয়োগকারী ও সম্পদ ভারতে অবস্থিত হয় এবং বিনিয়োগ ভারতীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে করা হয়ে থাকে, তবে বিদেশি সালিশি (arbitration) প্রক্রিয়া চললেও ভারতীয় আদালত আর্বিট্রেশন অ্যান্ড কনসিলিয়েশন অ্যাক্ট, ধারা ৯ অনুযায়ী এক্তিয়ার রাখবে।
চন্দ্র বলেন, “এটি সীমান্ত-অতিক্রমী ওয়েব৩ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত, যারা ভারতীয় ব্যবহারকারীদের সেবা দেয়।”
ব্যবহারকারীর সম্পদ অন্যের ক্ষতি ঠেকাতে ব্যবহার করা যাবে না
আদালত WazirX ও তার বিদেশি সহযোগী Zettai কর্তৃক প্রস্তাবিত তথাকথিত “Socialization of Losses” প্রকল্পটি সরাসরি খারিজ করে দেয়। ওই প্রকল্পে বলা হয়েছিল, এক ব্যবহারকারীর ক্ষতি অন্য ব্যবহারকারীর সম্পদ থেকে পুষিয়ে দেওয়া হবে। বিচারপতি ভেঙ্কটেশ মন্তব্য করেন, “যে সম্পদ Zanmai (WazirX)–এর নয়, তা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পূরণে ব্যবহার করা সংগত নয় এবং তা ন্যায়সংগত বলেও বিবেচিত হতে পারে না।”
এর ফলে আদালত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে ব্যবহারকারীর সম্পদ ‘ট্রাস্ট’-এ রাখা থাকে এবং তা অন্যের ক্ষতি মেটাতে বা কোনও বিদেশি পুনর্গঠন প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে না।
শরৎ চন্দ্রের মতে, এই নীতিটি কার্যত এমন এক নজির তৈরি করেছে যা বিদেশি কোম্পানিগুলিকে ভারতীয় ব্যবহারকারীর ডিজিটাল সম্পদে হস্তক্ষেপ বা বিদেশি ইনসোলভেন্সি স্কিম চাপিয়ে দিতে বাধা দেবে—বিশেষ করে যখন সম্পদ বা ওয়ালেট ভারতীয় বিচারব্যবস্থার আওতায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই রায় কেবলমাত্র ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারীদের জন্যই নয়, বরং ভারতের সামগ্রিক ডিজিটাল সম্পদ নীতির ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। এর মাধ্যমে ভারতীয় আদালত স্পষ্ট করেছে—ডিজিটাল যুগে সম্পত্তির ধারণা কেবল মাটি বা ঘরবাড়িতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভার্চুয়াল সম্পদও আইনের দৃষ্টিতে সুরক্ষিত।
