নিজস্ব সংবাদদাতা: তাঁর ছোটবেলাটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, কলকাতার নববর্ষ অথবা দুর্গাপুজোর থেকে বেশ অনেকটা দূরেই কেটেছে। অন্য দেশে শুধু নয়, বরং মহাদেশে। তিনি, জনপ্রিয় পরিচালক মৈনাক ভৌমিক। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা। তবে বাংলা বলা থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় তিনি আর পাঁচটা বাঙালির মতোই। বাংলা ছবির প্রতি তাঁর ভালবাসার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। তাঁর সঙ্গে চলা আড্ডায় উঠে এল  প্রবাসী বাঙালির ‘বাঙালিয়ানা’র গল্প, বাংলার প্রতি ভালবাসা আর তাতে সময়ের পালাবদলের প্রভাব। খোলাখুলি আড্ডা দিলেন আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে। একেবারে তাঁর পরিচিত ‘বাপি বাড়ি যা’ স্টাইলে।     


“আমার ছোটবেলা কেটেছে নিউ ইয়র্কে। আমেরিকায়। বাংলা নববর্ষের দিন সাধারণত ছুটির দিনে পড়ত না। তাই আর পাঁচটা দিনের মতোই স্কুলে যেতে হত।  তাই বাংলা নববর্ষের কিছুই উদযাপন করতে পারতাম না। তবে যেটা হ, বাড়িতে কিন্তু এই দিনটা পালনের একটা চেষ্টা দেখতাম। ছোট করে হলেও। চাপা আফসোস-ও লক্ষ্য করেছি বড়দের মধ্যে ঠিকভাবে যেহেতু দিনটা উদযাপন করা যাচ্ছে না।  তখন বছরে এক-দু'বার ছুটিতে কলকাতায় আসতাম। কিন্তু সেটা যে নববর্ষ উপলক্ষে তা কিন্তু নয়। যায় হোক... নববর্ষ কী, তার স্বাদ পেয়েছিলাম কলকাতায় ফেরার পর। বেশ লেগেছিল প্রথমবার পরিচয়েই। নিজের সংস্কৃতিকে পালন করা সবাইকে নিয়ে, একটু ভাল খাওয়া-দাওয়া, নতুন পোশাক। সব মিলিয়ে বেশ একটা খুশি খুশি ব্যাপার। দিব্যি লেগেছিল।”

 

“আর একটা কথা। এখনকার যাঁরা প্রবাসী বাঙালি, বিশেষ করে এ প্রজন্মের তাঁরা ক'জন বাংলা বলতে, পড়তে, লিখতে পারে সে ব্যাপারে আমার বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। অধিকাংশ-ই পারে না। তার-ও কারণ আছে। একটু খুলেই বলি, তাহলে। আসলে প্রবাসী বাঙালির প্রজন্মও তো বদলাচ্ছে। আমাদের মা-বাবার কিন্তু বাংলা বলা, লেখা, বাংলা সাহিত্য এগুলো বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ওখানে। কষ্ট করে হলেও। আমি নিজে বড় হয়ে ভাল করে বাংলা ভাষা শিখেছি যদিও। তাগিদ তো ছিলই। তবে ওই যে ছোট থেকে দেখেছি আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা কীভাবে তাঁদের মা-ভাষাটাকে ভালবাসে...সেটা খুব প্রেরণা দিত। এবার হয়েছে কি, আমার প্রজন্মের অনেকেই যাঁরা ওখানে থাকেন তাঁদের বেশিরভাগ বাংলা নিয়ে চর্চা করেনি, ভালবেসে কাছেও টানেনি তাই যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে। আমেরিকার এখনকার একজন প্রবাসী বাঙালি বাংলা ক্যালেন্ডার দেখতে পারে?  কারও বাড়িতে আদৌ আছে বাংলা ক্যালেন্ডার?”

 

“এবার আসি তাঁদের পরের প্রজন্মের কথায়। যাঁদের ধরুন এখন ১০-১৫ বছর বয়স।   তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলতেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে ফোন,ট্যাব। পৃথিবীটা খুব ছোট্ট হয়ে আসছে। নেটফ্লিক্স-এর মতো নানান ওটিটিকে ঘিরে চলছে বিনোদন। তাই তারাও ঝুঁকছে ওদিকে। এ প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালির কাছে বিনোদন মানে অ্যানেমি, স্কুইড গেমস!  হিন্দি ছবি ছেড়ে দিন বাংলা ছবি দেখে না তারা।  আমাদের ছোটবেলায় টিভি একসঙ্গে দেখতে হত, ওটাই চল ছিল।  নিজের মতো করে আলাদা আবার কী! এভাবেই বাংলা ছবি, হিন্দি ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। শিকড়টা বুঝেছিলাম। আর এখন তো একসঙ্গে বসে দেখা দূর অস্ত, টিভির কনসেপ্টটাই প্রায় উঠে গিয়েছে ,সবার হাতে ফোন, ইন্টারনেট। নিজের ইচ্ছেমতো দেখো, বন্ধ করি, পাল্টে ফ্যালো। তাই ওটিটি খুলে বিদেশের বর্তমান বাঙালি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলাকে দূরে ঠেলে  যে বিদেশি ওয়েব সিরিজ দেখবে তাতে আর আশ্চর্যের কী!”

 

মৈনাকের কথায় স্পষ্ট, নিজের শিকড়ের প্রতি টানটা ভুলে যাওয়া যত সহজ, ততটাই দরকার সেটাকে মনে করিয়ে দেওয়া।